ব্যাংকিং কমিশন কি ক্ষত সারাতে পারবে
ড. মোহাম্মদ তারেক অর্থসচিব থাকাকালে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর জন্য প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশনের একটি ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ খসড়া করে দিতে বললেন। যদ্দুর মনে পড়ে, আমি গণচীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের ব্যাংক ও মন্দঋণ সংস্কারের আলোকে একটি নাতিদীর্ঘ খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলাম।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংস্কার দীর্ঘদিন থেকে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশের বর্ধিষ্ণু খেলাপি ঋণ সম্পর্কে অনেক কিছু বলা ও লেখা হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। মনে হচ্ছে আলোচ্য ইস্যু নীতিনির্ধারক ও প্রস্তাবিত সংস্কারের কেন্দ্রীয় মনোযোগের বিষয় হিসেবেই রয়ে যাবে।
অবশ্য আমাদের এ মানসিকতা এড়ানো উচিত হবে না যে খেলাপি ঋণ কেবল আমাদের দুর্বল সুশাসন কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ফল। রাজনৈতিক প্রভাব, দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং জবাবদিহি-স্বচ্ছতার ঘাটতি সবই আমাদের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অবনমন ঘটিয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অধিক সাধারণ ও বৃহৎ পরিসরে কেলেঙ্কারি ও লুটপাট হয়ে আসছে।
আলোচ্য অর্থ কেলেঙ্কারির পেছনে মূল কারণ ছিল দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা চর্চা ও যথাযথ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। এমনকি এ ঘটনার পর যারা দায়ী ছিল, তাদের যথাযথভাবে বিচারের আওতায়ও আনা হয়নি। এটি আমাদের সুশাসন কাঠামোয় প্রোথিত সার্বিক জবাবদিহির ঘাটতির নির্দেশক।
রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়া দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু দেশে এটি সাধারণ চর্চা। এটি কেবল ক্ষুদ্র একটি মহল বা একটি খাতে ঋণের কেন্দ্রীভবনই ঘটাতে পারে। ফলে ঝুঁকি বাড়বে এবং একচেটিয়াপনা উৎসাহিত হবে। ব্যাংকিং কমিশন যদি স্বাধীন না হয় এবং এসব রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারে, তাহলে অর্থবহ সংস্কারের সুযোগ কমই রয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে যেহেতু বেশ কিছু কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং কমিশন একাই সবকিছু সমাধান করতে পারবে না। সুশাসন সমস্যার সমাধানে ব্যক্তি খাতের অংশীজনেরাও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্ধিষ্ণু পরিপালন শর্ত পূরণ এবং আর্থিক অপরাধ ও সংকটের জটিল প্রকৃতির জন্য সামনের বছরগুলোয় পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য ও জ্ঞান বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার জন্য আমাদের এটি বিশেষভাবে প্রয়োজন।
আমরা যেভাবে ব্যাংক পরিচালনা করি, তাতে বড় ধরনের সংযোগহীনতা বিদ্যমান। আমাদের এখানে অ-আনুপাতিক সংখ্যক রিটেইল শাখা রয়েছে। আপেক্ষিকভাবে ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংকের শাখার কেন্দ্রীভবন অন্যতম সর্বোচ্চ। আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা উচিত, এটি জরুরি কি না কিংবা রিটেইল শাখাগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের অদক্ষতার প্রধান উৎস কি না।
সর্বোপরি প্রযুক্তির শক্তি সম্ভবত বিশ্বব্যাপী গতানুগতিক ব্যাংকিং খাতকে ব্যাহত করবে এবং সেদিক থেকে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। গত ২০ বছরে নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশে মুঠোফোন–সেবার অভিনব মাত্রায় গ্রাহক বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে এর গ্রাহক ভিত্তি অধিকতর বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মুনাফা যোগ্যতা কমে গিয়ে রিটেইল শাখাগুলো অপ্রয়োজনীয় বোঝায় পরিণত হবে।
অধিকন্তু যথেষ্ট সন্দেহ আছে যে অধিকসংখ্যক ব্যাংক মৌলিকভাবে বাজার চাহিদা দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে কি না। গত দশক কিংবা তারও অধিক সময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক প্রণোদনা ও সম্পৃক্ততায় অনুমোদন পেয়েছে বলে সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজে বলেছেন। কাজেই এটি বিস্ময়ের নয় যে এসব ব্যাংক উচ্চ খেলাপি ঋণ ও লোকসানের বোঝায় জর্জরিত হতে পারে।
দুর্বল সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা ব্যাংকগুলোর মুনাফা মার্জিনে হুমকি তুলে ধরে। ঋণের মেয়াদ আমানতের মেয়াদের চেয়ে (এক থেকে তিন বছর) অনেক বেশি, যেটি এমনকি ১২ বছর পর্যন্ত হতে পারে। সময়ের এই ব্যবধান বা অমিল বাজার, তারল্য ঝুঁকিসহ ব্যাংকগুলোয় অসংখ্য ঝুঁকি উন্মোচন করে।
ব্যাংকিং খাতে প্রোডাক্ট-অফারিং আরেকটি ক্ষেত্র, যেখানে লক্ষণীয় উন্নতির সুযোগ আছে। বন্ড ও ইক্যুইটি মার্কেট এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ঘাটতিতে সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার একটি প্রবণতা বিরাজমান।
যদিও গেল বাজেটে নিত্যনতুন আর্থিক উপকরণ সৃষ্টির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তবে তা খুব একটা সহজ হবে না। বিনিয়োগকারীরা উচ্চ সুদ আশা করেন এবং তাঁরা করপোরেট বন্ডের চেয়ে সরকারি সিকিউরিটিজের সঙ্গে বেশি পরিচিত।
এ ক্ষেত্রে একধরনের সচেতনতা ঘাটতি আছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগে অনিচ্ছুক। ইস্যু করার উচ্চ ব্যয় এবং পুঁজিবাজারের অন্য প্রতিবন্ধকগুলো বন্ড বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরুৎসাহিত করে। আমরা আমাদের বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন ঘটাতে পারব কি না, তা নির্ভর করবে বন্ডের তারল্য, প্রয়োজনীয় জামানতীকরণ এবং সংশ্লিষ্ট উপকরণগুলোর সিকিউরিটাইজেশনের ওপর।
একটি জোরালো বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠার পথনকশায় অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, বন্ড ইস্যু করার ব্যয় কমানোর প্রচেষ্টা এবং ইস্যুকারী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আমাদের ব্যাংকগুলো প্রোডাক্ট-অফারিংয়ের ক্ষেত্রেও সুদ উপার্জনকারী উপকরণগুলোর ওপর বেশি মনোযোগ দেয়, যার সঙ্গে উচ্চ মাত্রার ঋণঝুঁকি ও স্থিতিপত্র ঝুঁকি যুক্ত থাকে। ব্যাংকগুলো আয়মুক্ত পণ্যভিত্তিক মডেলে স্থানান্তরিত হলে এ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঝুঁকি কমে আসতে পারে। এ ধরনের ব্যাংকিং পণ্যের উদাহরণ হতে পারে এটিএম ফি, হিসাব যাচাই ফি, সম্পদ ব্যবস্থাপনা সেবা, পুঁজিবাজারসংক্রান্ত পণ্য এবং অন্য পরামর্শমূলক পণ্যসেবা।
এই রূপান্তর সফল করতে হলে নিজস্ব গ্রাহক সেবা ও সুনাম তৈরিতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই গ্রাহক আস্থা অর্জন এবং ব্র্যান্ড আনুগত্য তৈরিতে সচেষ্ট হতে হবে। নতুন ও কার্যকর প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মগুলোতে অধিক বিনিয়োগ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে এগিয়ে নেবে। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার পদক্ষেপের ক্ষেত্রে মানবসম্পদে বিনিয়োগও অন্যতম প্রধান উপাদান। ব্যাংকগুলোর মানবসম্পদ বিভাগগুলোকে তাদের লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে গুণভিত্তিক ও নৈতিক হওয়া উচিত। এটি কর্মীদের কর্তৃক পরিপালন নজরদারি এড়ানো, অত্যধিক ঝুঁকি নেওয়ার আচরণ এবং স্বজনতোষণ কমাতে পারে।
প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে আমাদের ব্যাংকিং খাত প্রভূতভাবে সুফল পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৬ সালে সংঘটিত বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারি অন্তত অংশত ঘটেছিল দুর্বল আইটি নিরাপত্তা দ্বারা, যেহেতু ব্যাংকের নেটওয়ার্কে কোনো ফায়ারওয়াল ছিল না।
আমরা বিশেষত সাইবার নিরাপত্তা ও সূক্ষ্ম ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কৌশলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা জোরদার করতে পারি। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ভালো করবে, যেহেতু এটি অপব্যবহার ঠেকানো এবং দ্রুততার সঙ্গে তাদের মূলধন বা পুঁজি সুরক্ষায় অধিক ভালোভাবে সমর্থ।
ব্যাংকিং খাতের বহুমুখী সমস্যার বাস্তবতায় নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁদের অবশ্যই থাকতে হবে সংস্কারধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি। আমার মতে, অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার পদক্ষেপ পরিচালনায় একটি শক্তিশালী ও সম্মুখদর্শী কেন্দ্রীয় ব্যাংকই অধিক প্রয়োজন। সংগত কারণেই সংস্কার কমিশনকে খেলাপি ঋণের বাইরেও অন্য অনেক মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক