কাজের তাগিদে এয়ারপোর্ট আমার প্রাত্যহিক জীবনের একটা অংশ। সপ্তাহে বেশ কয়েকবার আসতে হয়। প্রথমবারের মতো এখন আর এয়ারপোর্টে আসতে বা বসে থাকতে আমার একদমই বিরক্তি লাগে না বা ক্লান্তি আসে না। আমার মনে হয় এয়ারপোর্ট হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আবেগঘন জায়গা। এখানে প্রত্যেক মানুষের যাত্রার একটি আয়োজন আছে। একটি উদ্দেশ্য বা উপলক্ষ আছে। আছে আকুলতা। এ আয়োজনগুলো অনেকের ক্ষেত্রেই দীর্ঘ বা একদমই হঠাৎ, অপ্রত্যাশিত। প্রতিটি যাত্রার পেছনে বলতে পারেন একটা গল্প আছে। কোনোটা শুরুর বা কোনোটা শেষের। গল্পগুলো একদম নিজস্ব। বৈচিত্র্যে ভরা। প্রতিটি গল্পে হয়তো একের বেশি চরিত্র আছে।
১.
হিথ্রো এয়ারপোর্টে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লাউঞ্জে বসে আছি। যাব ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো। কাজে। বেড়াতে নয়। আমার মতো কেজো যাত্রীদের এয়ারপোর্টে বসে থাকলেও কাজ করতে হয়। কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকা। আর মাঝেমধ্যে মানুষ দেখা। প্রতিটি মুখে আশা, নিরাশা বা প্রত্যাশার ছাপ।
পাশের যাত্রী হঠাৎ করে বললেন, ‘আচ্ছা, এখানে খেতে হলে কি পয়সা দিতে হবে?’ বয়সটা বড়জোর ২৫। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। হেসে দিয়ে বললাম, ‘একদমই নয়। যা খুশি, যত খুশি খেতে পারো। কোনো পয়সা দিতে হবে না।’ নিজ থেকেই বলল, এর আগে সে কখনো বিজনেস লাউঞ্জে আসেনি। খাবার নিয়ে এসে নিজে থেকে আলাপ শুরু করল।
অক্সফোর্ড থেকে ম্যাথমেটিকেল মডেলিংয়ে মাস্টার্স করেছে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের চাকরি নিয়ে নিউইয়র্কে যাচ্ছে। বড় বেতন। প্লেনের সবচেয়ে উঁচু শ্রেণিতে ওঠার খরচ কোম্পানি দিয়েছে। মা-বাবা শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তামিল শরণার্থী। বাবা ট্যাক্সি চালিয়ে, রাতে পেট্রলপাম্পে কাজ করে ছেলেকে লন্ডনের বড় স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে অক্সফোর্ড। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে এল। ডাক পড়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছিল না। এ যাত্রা তো শুধু লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক নয়। নিঃস্বার্থ এক বাবার সাফল্যের গল্প। বাবাদের গল্প। অদম্য এক মেধাবীর অর্জনের গল্প।
২.
লন্ডন থেকে প্লেন ছাড়ল বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরিতে। গন্তব্য ঢাকা। মাঝে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। নেমেছি কাতারের রাজধানী দোহায়। এয়ারপোর্টে বসে আছি। সঙ্গে আমাদের ছেলে। ওর বয়স তখন ১০। রাত দুইটার মতো হবে। খিদে পেয়েছে, ছেলে নিচু গলায় আমাকে বলল। বিলেতে জন্ম হলেও ভেতো বাঙালি। এত রাতে এয়ারপোর্টে শুকনা স্যান্ডউইচ বা চকলেট ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তার সম্ভাবনাও কম। বললাম, কিছুক্ষণ পরে খাবারের দোকানগুলো খুলবে, তখন দেখা যাবে।
মিনিট দশেক পরে দেখি মধ্যবয়স্ক এক বাঙালি ভদ্রলোক আমার ছেলের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। এই এয়ারপোর্টেই কাজ করেন। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন। পাশেই বসে ছিলেন। আমাদের কথা শুনে আর বসে থাকতে পারেননি। এয়ারপোর্টের রেস্টুরেন্টে তাঁর বন্ধুরা কাজ করে। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হলেও ভেতর থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। কিছু না বলে খাবারটা নিলাম। একটু আগেও যাঁর অস্তিত্ব আমার কাছে পাশে বসা, মনে না রাখা একজন সাধারণ যাত্রীর মতো ছিল, তাঁর আতিথেয়তা আমার চোখে জল নিয়ে এল। দুজনে অনেকক্ষণ কথা বললাম।
ভদ্রলোক বহু বছর কাতারে থাকেন। দেশে যাচ্ছেন মেয়ের বিয়ের জন্য। মুখে আনন্দের ছাপ। পাশে অনেক যাত্রী। মাঝরাত। কিন্তু কারও চোখে ঘুম নেই। প্রত্যেকেই একটা অপেক্ষা নিয়ে বসে আছেন। অন্যদিকে কাউকে দেখার। বাংলাদেশের উন্নয়নের সূচক তরতর করে বেড়ে চলেছে। সূচকগুলো দাঁড়িয়ে আছে এই মানুষগুলোর কাঁধে ভর করে।
৩.
ক্রিস আর আমি একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। ক্রিসের বড় হয়ে ওঠা বিলেতের এক অতি সাধারণ পরিবেশে। ছোটবেলায় ক্রিসের বাবা ওর মাকে ছেড়ে চলে যায়। মা একা ক্রিস আর তার ভাইকে বড় করেছে। ক্রিস বিলেতের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। কাজের প্রয়োজনে বছরের পর বছর আমি আর ক্রিস ইউরোপ-আমেরিকার এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে যেতাম। কাকডাকা ভোরে বা গভীর রাতে আমরা বসে থাকতাম এয়ারপোর্টে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। এয়ারপোর্টে বসে অনেক সময় উদাসীন হয়ে যেত ক্রিস। প্রতিবার এয়ারপোর্টে বসে ওর মাকে একটা ফোন করত। চাকরি পাওয়ার আগে ক্রিস, তার মা ও ভাই—কেউই প্লেনে কখনো চড়েনি। ক্রিস বলত, প্রতিটি যাত্রা তার কাছে একটা স্টেটমেন্ট। তার মায়ের কাছে কৃতজ্ঞতার আর জগতের অন্য সবার কাছে অর্জনের।
৪.
কেমব্রিজে অনেকগুলো কলেজ। অন্যতম হলো ট্রিনিটি। কৌলীন্য আর উৎকর্ষে অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। মাস্টার অব ট্রিনিটি বা ট্রিনিটির অধিকর্তা। নিয়োগ দেন স্বয়ং রানি। বিলেতে বেশ কিছু পদ আর পদবি আছে, যেগুলো শিক্ষিত লোকের চর্চার বিষয়। এটি তার অন্যতম। নামকরা বিজ্ঞানী বা নোবেল লরিয়েটকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল। ট্রিনিটির মাস্টার ছিলেন প্রফেসর অমর্ত্য সেন। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার একাধিক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করলেও অমর্ত্য কখনো ব্রিটেন বা আমেরিকার নাগরিকত্ব নেননি। ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়েই চলাচল করেন। বিলেতের নাগরিক নন—এমন মানুষকে ইংল্যান্ডে ঢুকতে হলে প্রতিবারই একটি ফরম পূরণ করতে হয়। অমর্ত্য ফিরছিলেন। লন্ডনে বিমানবন্দরে থামলেন। ঠিকানার জায়গায় অমর্ত্য লিখলেন, ‘মাস্টার্স লজ। ট্রিনিটি কলেজ। কেমব্রিজ।’ হিথ্রো এয়ারপোর্টের অভিবাসন কর্মকর্তা অমর্ত্যকে বললেন, ঠিকানাটা হয়তো ঠিক নেই। অমর্ত্য বললেন, ‘ঠিক আছে।’ ‘মাস্টার অব ট্রিনিটি কি তোমার বন্ধু?’ স্মিত হাসি দিয়ে অমর্ত্য বললেন, ‘না, আমি নিজেই।’
এয়ারপোর্ট হলো এমন জায়গা, যেখানে আমাদের অফিশিয়াল পরিচয়পত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট দেখাতে হয়। ইমিগ্রেশন শেষ হলেই আমরা কেউ জানি না পাশের কারও পরিচয়।এয়ারপোর্টেই সময়ের পরিক্রমায় আমাদের পরিচয়ের পরিবর্তন হয়। ঢাকা থেকে যখন বিলেতে এসেছিলাম আমার পরিচয় ছিল বাংলাদেশি। এখন যখন ঢাকা যাই—প্রতিবার এয়ারপোর্টে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। কারণ, আমার পরিচয়ের পরিবর্তন হয়েছে। এই এয়ারপোর্টেই অনেককে পরিচয়হীন হয়ে যেতে হয়।একবার বার্লিনে ইরানি এক ট্যাক্সিচালক বলেছিল কীভাবে টেগল এয়ারপোর্টের টয়লেটে তাঁর পাসপোর্ট ফেলে দিতে হয়েছিল।
এই এয়ারপোর্টেই কোনো দেশ বা জাতির রুচি, শিক্ষা, আভিজাত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, আইনের শাসন, সহনশীলতা ও উন্নয়নের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের দেশগুলোয় কর্তাব্যক্তিরা এগুলো অনেক সময়ই ভুলে যান। মহামারির পর এয়ারপোর্টগুলো আবার সচল হতে চলেছে। দেশ থেকে দেশান্তরে। সবার স্বপ্নের উড়াল শুভ হোক।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]