বৈশাখেরই ভোরের হাওয়ায়

ভোরে অনেক কাজ। পাখির ডাক শোনা। দূরাগত আজানের ধ্বনি, আস্তে আস্তে রিকশার ঠুং ঠাং, গাড়ির প্যাঁ পেঁা, হকারদের চিৎকার। পরিচিত কণ্ঠ, ‘ছাই, নেবেন ছাই’? ছাইয়ের প্রয়োজন নেই যাদের, বিরক্ত তারা। যার প্রয়োজন, ছাইয়ের মধ্যেই খুঁজছে অমূল্য রতন। ছাই ছাড়া অনেক কিছুই হয় না। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা সারা রাত ধরে বড় বড় সাইজের পাখি ইত্যাদি বানিয়ে শোভাযাত্রা করেছে, যেখানে সারা বছরের মঙ্গল নিহিত বলে তাদের ধারণা। মঙ্গল সেখানেই, যেথায় মঙ্গলের আবাহন।
৬ রজব ভুলিনি। চান্দ্রমাসের বিবর্তনে ৬ রজব এসে হাজির পয়লা বৈশাখ। খাজা বাবার ভক্তরা ভোলেনি, উনি যে গরিব নেওয়াজ, গরিবের সেবক। আজমির শরিফে হাজির। পৃথিবীর সব দরিদ্র ব্যক্তি এখানে হাজির খাজা বাবার ডেকচি থেকে অমূল্য এক শালপাতায় মোড়ানো খাবারের জন্য। ভেবেছিলাম এরা বুঝি সবাই দরিদ্র মুসলমান। তা নয়। বরং মুসলমানরা চাঁদা দিয়ে ডেকচির পর ডেকচি রান্না করেছে সারা রাত তাদের হিন্দু ভাইদের খাওয়াবে বলে। গরিব নেওয়াজের ভলান্টিয়ারদের দৃষ্টি সবার দিকে। যে কিছুই পায়নি, তার জন্যও কোথা থেকে অন্ন এসে হাজির। বলা যায়, এটাই মঙ্গলের আবাহন।
কলকাতা থেকে ফিরেছে বড় মেয়ে। বলল, বাঙালি খাওয়া খেতে হলে যেতে হবে ‘শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না’র দোকানে, নতুন ‘মধ্য আয়ের’ চেইন। খ্যাতনামা শিল্পী মান্না দের সঙ্গে এই ভজহরি বাবুর নেই বিন্দুমাত্র যোগসূত্র। উদর ভজনায় যাঁরা উৎসাহী, কলকাতার এই নতুন চেইনে পাবেন বাঙালি ভোজ। দাম বেশি নয়, রেস্তোরাঁর মান নিচের দিকে। ‘মধ্য আয়ের’ বাঙালিরা ওখানে ঢুকবেন কি না সন্দেহ। শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা আমাকে বললেন, ‘দাদা, ঢাকায় এসেছি, বিরিয়ানি খাওয়াবেন না?’ গেলাম ঢাকা ক্লাবে। উন্নত মানের রান্নাঘর, সবই উন্নত মানের। কিন্তু বিরিয়ানি? নিয়ে এলাম চকবাজারের হাজির বিরিয়ানি। শিল্পী খেয়ে বললেন, এমনটি শুধু ঢাকাতেই পাওয়া যাবে। আমার পয়লা বৈশাখ সার্থক।
স্মোকড ইলিশের রান্না নতুন গিন্নিদের করায়ত্ত না হওয়ারই কথা। ‘খাদ্য রান্না পুষ্টি’-তে নেই। পদ্মার ইলিশ কেমন করে চিনতে হয় তা জানার জন্য অভিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে বাজারে যেতে হয়। যেকোনো ইলিশে রান্নাটি জুতসই হবে না, যে ইলিশ বরফ চেনেনি ও সদ্য নদী আহরিত, তার রান্নাই অভীষ্ট। মাছটি ধুয়ে, ফিলে দুটোর ওপর ছুরি দিয়ে চারটে তেরছা ও চারটে সোজা লাইন টানুন। অল্প চিরে দিন। ভিনেগার ও উস্টার সসে মাছের ফিলে ভিজিয়ে রাখুন অন্তত দুই ঘণ্টা। দুই ঘণ্টা বাদে ইলিশের কাঁটা ছাড়ান। চিরে রাখা অংশ থেকে টেনে টেনে কাঁটা বের করতে হবে। সেঁকার আগে নুন ছড়িয়ে নিন। তন্দুরে বা বালতির উনুনে জ্বলন্ত কাঠকয়লা রেখে তাতে খই ফেলুন। বেশ ধোঁয়া উঠবে। এতে মাছের ফিলে রেখে ঝুড়ি চাপা দিন। ধোঁয়ায় মাছ রান্না হবে। ২০ থেকে ৩০ মিনিট এভাবে রাখুন। মাছে বাদামি রং ধরলে তুলে পরিবেশন পাত্রে রাখুন। পটেটো জুলিয়েন, লেবুর স্লাইস ও পার্সলে দিয়ে সাজিয়ে বাটার সস-সহযোগে পরিবেশন করতে হবে। বাটার সসের জন্য মাখন গলান। এতে লেবুর রস ও নুন-মরিচ দিন। এ ছাড়া পটেটো জুলিয়েন তৈরির জন্য আলু সরু সরু দেশলাইয়ের কাঠির মতো কেটে, বরফঠান্ডা জলে ভিজিয়ে গরম তেলে ভেজে নিন।

>বৈশাখী হাওয়া নিদাঘের হাওয়া। চারদিকে গরম বাতাস, হাঁসফাঁস, শুধু উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাস না হলে জীবনে কিছু নেই, তাই একটি দিন কবুল করি উচ্ছ্বাসের কাছে

ময়মনসিংহের এক কবি লিখছেন: রাজার ভুঞ্জনি মাছ অতিথ ভুলানি মাছ/ রান্ধনী পাগল মাছ/ ইলিশারে। সংস্কৃত শ্লোকে পাওয়া যাচ্ছে: ইলিশখলিশশ্চৈব ভেটকি মদগুর এব চ রোহিতো মৎস্যরাজেন্দ্র পঞ্চমৎস্য নিরামিষাঃ। কয়েকটি মাছকে বিধবাদের আহারোপযোগী বলে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। এখন যে রান্নাটি শেখার আহ্বান সেটি: ইলিশ পাতুরি। শিখেছি চ্যানেল আইয়ের কেকা ফেরদৌসীর কাছে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। আমার রান্না খেয়ে গিন্নি বললেন, যেকোনো রেস্টুরেন্টের চেয়ে ভালো। ঢাকার কোনো রেস্টুরেন্টে অবশ্যই ইলিশ পাতুরি পাওয়া যায় না।
উপকরণ: ইলিশ মাছের টুকরো, সাদা সরষেবাটা ১ টেবিল-চামচ, কাঁচা মরিচবাটা ১ চা-চামচ, আদা-রসুনবাটা ১ টেবিল-চামচ, কাঁচা মরিচ ৪টা, সরষের তেল ১ টেবিল-চামচ, নুন স্বাদমতো, কলাপাতা চার টুকরো [ধুয়ে পরিষ্কার করা]। গুলশান সাউথ লেকে কলাগাছ প্রচুর।
প্রণালি: একটা কাচের পাত্রে মাছ রেখে সব মসলা দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। এক একটা কলাপাতায় একটা করে মসলা মাখানো ইলিশের টুকরো ও একটা করে কাঁচা মরিচ রেখে মুড়ে ফেলুন। স্টিমারে দিয়ে ২০ মিনিট স্টিম করে নামান। স্টিমার না থাকলে হাঁড়িতেও রান্না করে নিতে পারেন। এর জন্য হাঁড়িতে তিন-চার কাপ পানি ঢেলে তাতে একটা বাটি উল্টে বসিয়ে তার ওপর একটা পাত্র রেখে সেই পাত্রে কলাপাতায় মোড়া ইলিশ রাখুন। জল ফুটতে থাকবে। এতেই রান্না হবে ইলিশ। রান্না হলে মোড়া পাতাসমেত ইলিশ গরম-গরম পরিবেশন করুন।
বৈশাখী হাওয়া নিদাঘের হাওয়া। চারদিকে গরম বাতাস, হাঁসফাঁস, শুধু উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাস না হলে জীবনে কিছু নেই, তাই একটি দিন কবুল করি উচ্ছ্বাসের কাছে। নেই কোনো আফসোস। একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন, ফসলি বা আকবরের ক্যালেন্ডার অগ্রহায়ণ থেকে শুরু করা যেতে পারে। এতে আমার আপত্তি নেই। কারণ, এটিই আমার জন্ম মাস। নিজে পালন না করলেও হয়তো অগ্রহায়ণে হলে দু-চারজন আমার বাসায় আসতেন। এখন কেউ কারও বাসায় যান না, যার বাসায় এসি নেই। এসি ছাড়া ‘মধ্য আয়ের’ মানুষেরা নিশ্বাস নিতে পারেন না। পান্তা খাইনি, খেতে আপত্তিও নেই। রাতে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে তারা বলল, এবার বাঙালি খাওয়ার নতুন আইটেম যোগ করেছি।
জানলাম নতুন নতুন আইটেমের খবর। শজনের ডাল। পছন্দ কামরাঙার ভর্তা। ঘোলের শরবত। পুঁটি মাছের সরুয়া। ডারকা মাছের চচ্চড়ি। বগুড়া আলুর ভর্তা, আলুর ডাল, পাটশাকের প্যালকা, শোল মাছের ঝোল, ফ্রিজের ডাবের পানি, নারকেলের মধ্যে গলদা চিংড়ির আবির্ভাব, টাকি মাছের ঝালভর্তা, চ্যাপা শুঁটকি। সব আইটেম মনে রাখতে পারিনি। পটোলের দোলমা ও পোস্তের দানা কোচবিহারের উন্নত সবজি রান্নার সাক্ষ্যবাহী। আমার মা এমন সব আইটেম রান্না করতেন, সিদ্দিকা কবিরের বইয়ে যা নেই। বড় মেয়ে যখন আমেরিকায় যায়, বইটি নিয়ে গিয়েছিল। এখন সে পাকা গিন্নি।
বৈশাখী দিন মানে পুরোনোর প্রতি অনুরাগ। মায়ের স্মৃতি জাগ্রত হলো।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]