বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ২০১৬ সালে নির্গত হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সর্বোচ্চ। সাম্প্রতিক এক ব্রিটিশ গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮৫০-১৯০০ কালপর্বে বিশ্বের আবহাওয়াকে ভিত্তিমান হিসেবে ধরলে ২০১৬ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কার্বন নিঃসরণের বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা উল্লিখিত প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সময়ের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মারাত্মক প্রভাব পড়বে। বৈরী পরিবেশের প্রভাবে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ফসলের মৌসুমে বৃষ্টিহীন প্রলম্বিত সময়, মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতি ও মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো দুর্যোগ বেড়ে যাবে।
আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক এবং মানুষের সৃষ্ট কারণ—দুটোই ভূমিকা রাখে। গত অর্ধশতকজুড়ে গবেষণা তথ্য নিশ্চিত করেছে যে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্বন ও অন্যান্য ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নিঃসরণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির চাঙাভাব বহাল থাকার সময় বাড়তি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং বাতাসে বেশি মাত্রায় কার্বনদূষণ হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের মাথাপ্রতি দূষণের হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও এর বিশাল জনগোষ্ঠী (১৩৮ কোটি) ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার প্রায় চার গুণ অধিবাসীসমৃদ্ধ চীনের মাথাপ্রতি কার্বনদূষণ অর্ধেকের কম। কিন্তু মোট দূষণের বিবেচনায় বিশ্বে চীনের অবস্থান এখনো শীর্ষে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পের অন্যান্য প্রয়োজন ও গৃহস্থালির চাহিদা মেটাতে চীন ও ভারত এখনো প্রবলভাবে কয়লার ওপর নির্ভরশীল। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট কয়লানির্ভর বিদ্যুতের ৪৪ দশমিক ১ শতাংশ চীনে উৎপাদন হয়। ওয়ার্ল্ড কোল জার্নালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যার তথ্য অনুযায়ী, চীন ও এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
কেবল কয়লা ব্যবহার নয়, মোটরগাড়ির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি বাতাসে কার্বনসহ অন্যান্য ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’-এর দূষণ দ্রুত বাড়িয়ে চলেছে। চীনের ৫০০ বড় শহরের মধ্যে এক শতাংশের কম শহরের বাতাসের মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান পূরণ করে। রাজধানী বেইজিংসহ শুষ্ক মৌসুমে চীনের অনেক বড় শহরে বায়ুদূষণের তীব্রতায় ‘মাস্ক’ পরে মানুষকে পথ চলতে দেখা বিরল ঘটনা নয়। দিল্লিসহ ভারতের অনেক শহরের বায়ুদূষণ তীব্র।
সম্প্রতি প্রকাশিত (২০ অক্টোবর ২০১৭) ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজনের মৃত্যু হয়েছে দূষণের কারণে। দূষণজনিত মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি বায়ুদূষণের কারণে ঘটেছে। দূষণের কারণে নিহত ব্যক্তিদের অর্ধেক চীন ও ভারতের অধিবাসী। এবং দূষণজনিত মৃত্যুর ৯২ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ঘটেছে। চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কেনিয়া ও মাদাগাস্কারের মতো দ্রুত শিল্পায়ন অভিমুখী দেশগুলোতে প্রতি চারটি মৃত্যুর একটি দূষণজনিত কারণে।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও সোমালিয়া তীব্র দূষণের শিকার। বাংলাদেশে শিল্পকারখানা ও মোটরগাড়ির সংখ্যা তেমন বেশি না হলেও বায়ুদূষণের তীব্রতা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, অপর্যাপ্ত রাস্তায় নিয়মিত তীব্র যানজট, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, জ্বালানির মান নিয়ন্ত্রণে অনীহা, পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, শহরের চারপাশে নিয়ন্ত্রণহীন ইটভাটার বিস্তার, বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা ছাড়া রান্না ও বসবাসের পরিবেশ ইত্যাদি।
তবে মানুষের সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন স্বাক্ষরিত চুক্তির বাধ্যবাধকতায় সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের সঙ্গে দূষণ বৃদ্ধির সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে। চীন ইতিমধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নির্ধারিত সময়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে অন্যতম কয়লা ব্যবহারে একক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে পর্যায়ক্রমে জ্বালানির বহুমুখীকরণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া। সে সঙ্গে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, বৈদ্যুতিক মোটরগাড়ি ব্যবহারে ব্যাপক অবকাঠামো নির্মাণ ও নীতি সহায়তা দিয়ে তা উৎসাহিত করা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে চীন সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারেও চীন সবচেয়ে এগিয়ে। ২০১৭ সালে চীনের শহরগুলোতে প্রায় ৭ লাখ বিদ্যুতে চালিত মোটরগাড়ি চালু হয়েছে। ২০২০ সালে ভারত জাতীয় পর্যায়ে বৈদ্যুতিক পরিবহনব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাপক পরিসরে বৈদ্যুতিক ট্রেন, মেট্রোরেল, বিদ্যুতে চালিত মোটরগাড়ি চালানো গেলে জ্বালানি তেল ব্যবহার, বায়ুদূষণ ও যানজট কমে।
বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বাংলাদেশের দূষণ নগণ্য (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে মাথাপ্রতি ১৬ দশমিক ২ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে বাংলাদেশে বছরে নিঃসরণ ০ দশমিক ৪৩ টন)। কিন্তু দূষণের তীব্রতা ও ক্ষতি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বাংলাদেশে। বায়ুদূষণের সঙ্গে আবহাওয়ার অস্থির আচরণের সম্পর্ক স্পষ্ট। অস্থির আবহাওয়া, বৃষ্টি-বন্যার অদ্ভুত আচরণে ফসলহানি, উন্নয়নের অর্জনগুলোর হুমকির মুখে পড়া আমাদের নিয়তির মতো সঙ্গী। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে বৈরী আবহাওয়ার ফলে আমাদের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তবু এ দেশের পরিশ্রমী মানুষ পিছিয়ে যায়নি, বরং উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে বৈরী পরিবেশে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।