বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি লোক প্রবাসে আছেন, যাঁদের বেশির ভাগই দেশে অর্থ পাঠান। তাঁরাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন হাজার কোটি (৩০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার করেছেন। নিজ দেশে কর্মদক্ষতা অর্জন করার পর বাংলাদেশিরা বিদেশে গেলে আমাদের বৈদেশিক আয় ফিলিপিনোদের মতো আরও অনেক বেশি হতে পারত। তা ছাড়া বাংলাদেশিদের ইংরেজিতে কথা বলার দুর্বলতা ফিলিপিনো, ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কানদের তুলনায় চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশি সাধারণ শ্রমিকদের ইংরেজি ও স্বাগতিক দেশের ভাষার দক্ষতা এবং কর্মদক্ষতা অর্জন ওই দেশে উড়াল দেওয়ার আগে অর্জন করলে বর্তমান আয় কমপক্ষে দ্বিগুণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে ‘প্রবাসী-আয় যেভাবে বাড়ানো সম্ভব’ শিরোনামে ১০ এপ্রিল ২০১৫ একটি নিবন্ধ প্রথম আলোয় লিখেছিলাম।
বছর তিরিশেক ধরে এই নিবন্ধকারের সুযোগ হয়েছে পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে আন্তর্জাতিক সংস্থা এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক), ডব্লিউবি (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক), জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সি) ও এমসিসির (মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন) অর্থায়নে অবকাঠামো প্রকল্পে পরামর্শক প্রকৌশলী হয়ে কাজ করার। লক্ষণীয়, ওই সব দেশে সহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশিদের দেখা পাওয়া যায় না। তবে আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে হাতে গোনা স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশি প্রকৌশলী কাজ করছেন।
চীনের নেতৃত্বাধীন আর একটি নতুন সংস্থা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) গত ১৬ জানুয়ারি বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। এই ব্যাংকটি ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশসহ ৩৭টি আঞ্চলিক ও ২০টি দূরাঞ্চলের সদস্যদেশ এর অংশীদার। ব্যাংকটি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণে অর্থের জোগান দেবে। তাই বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ এসেছে।
বাংলাদেশি একজন দক্ষ প্রকৌশলীর পারিশ্রমিক বিদেশে কর্মরত ৩০-৪০ জন শ্রমিকের পারিশ্রমিকের সমান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক আছেন, যাঁরা নিজ দেশে অবকাঠামোগত প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পেয়ে বিদেশি পরামর্শক হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছেন। তার অন্যতম কারণ বঙ্গবন্ধু সেতুসহ সীমিত কিছু প্রকল্প ছাড়া কাজের ক্ষেত্র পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমানে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু এ ক্ষেত্রে বিশাল একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
এরপর এমআরটি–৬ (মেট্রো রেল ট্রান্সপোর্ট) সহ আরও বড় বড় প্রকল্প আসছে। এসব প্রকল্পে কাজ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অনেক দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি করতে পারে, যাঁরা বিদেশে পরামর্শক হিসেবে কাজ করে নিজের ও দেশের জন্য অর্থ ও সম্মান দুই-ই অর্জন করতে পারবেন।
তবে এসব প্রকল্পের পরামর্শক ও ঠিকাদারদের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক হওয়ায় বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সরাসরি অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। তাই এ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নবীন-প্রবীণ প্রকৌশলী, দেশের পাঁচটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কারিগরি শিক্ষাঙ্গনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী (দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষ) এবং তাঁদের শিক্ষকদের পদ্মা সেতু থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া দরকার।
তাঁরা যেন ভবিষ্যতে তাঁদের জীবনবৃত্তান্তে সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আরসিসি ও স্টিলের তৈরি দ্বিতল পদ্মা সেতু নির্মাণ থেকে শিখেছেন তা লিখতে পারেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় এই শিক্ষাদানের বিশেষ ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা থাকা দরকার। পদ্মা সেতুতে সরাসরি কর্মরত বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা আগত শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি করবেন। সেতু নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে সেতুর সাবস্ট্রাকচার (নিচ) ও সুপারস্ট্রাকচার (ওপর) উভয় অংশের ওপর এই প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রত্যেক শিক্ষার্থী অন্তত দুবার সাইট ভিজিট করে প্রশিক্ষণ নেবেন। শুধু কাঠামোগতই নয়, নদীশাসন থেকে শুরু করে পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার বিষয়ও প্রশিক্ষণের অংশ থাকবে।
পুর, পানিসম্পদ, যন্ত্র, বিদ্যুৎ, পরিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ পদ্মা সেতুতে আছে। একমাত্র পুরকৌশলের মধ্যেই রিভার ব্যাংক প্রোটেকশন, হাইওয়ে, স্ট্রাকচার, ম্যাটেরিয়াল, ডিপ-ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ আছে।
এই ব্যবস্থায় কয়েক হাজার প্রকৌশলী ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর ট্রেনিং সেশনাল ক্লাস হিসেবে গণ্য হতে পারে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা নিজ দেশের ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোতে যেমন অবদান রাখবেন, তেমনি বিদেশে কাজ করেও রেমিট্যান্স আয় করবেন।
বর্তমানে আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে উচ্চ পারিশ্রমিকে কাজ করা বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু সেতুতে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তাই পদ্মা সেতুর প্রশিক্ষণের ভবিষ্যৎ বেনিফিট বা সুবিধা এই সেতুর নির্মাণ খরচ সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি হবে। কারণ ২৫ বছরের একজন শিক্ষার্থী আগামী অন্তত ৪০ বছর ধরে এই প্রশিক্ষণের সুবিধা উপভোগ করবেন এবং দেশের জন্য অর্থ ও সুনাম উভয়ই অর্জন করবেন। প্রকৌশলীদের সব সময় অবকাঠামো বিনির্মাণে অবদান রাখতে হয়, যা একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি বলে পরিগণিত হয়।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।