বেদেসমাজের ওপর কি রহম করা যায় না?
খবর এসেছে, নোয়াখালী থেকে শত শত বেদে নারী-পুরুষকে খোলা আকাশের নিচে বসবাসে বাধ্য করা হয়েছে। প্রায় ৫০টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, ৩০টি বাড়ি পুড়ে ছাই। বাকিগুলো আধা পোড়া, ভাঙাচোরা। নোয়াখালী সদর উপজেলার পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের বেদিপল্লিতে দিনেদুপুরে পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় বিপথগামীরা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ১০ সেপ্টেম্বর। স্থানীয় ইউপি সদস্য আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেতৃত্বে আগুন আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন। এ যেন ২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লি পুড়িয়ে দেওয়ার চিত্রনাট্যেরই অনুলিপি।
কী ছিল এবারের ছুতো?
৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কড়ইতলা এলাকার এক দোকানে এক বেদে কিশোরী আইসক্রিম কিনতে গেলে দোকানে বসা এক বখাটে ওই কিশোরীর সঙ্গে অসভ্য আচরণ করে। বেদে নারীদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা সিনেমা–নাটকের কারিশমায় এখন আমাদের নিত্য খাসলতে পরিণত হয়েছে। তাঁদের প্রতি আমাদের নির্দয় আচরণের যে বর্ণনা ১৯৫১ সালে কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘বেদের মেয়ে’ কাব্যনাটকে দিয়েছিলেন, তা এখনো বলবৎ। তবে দিন পাল্টেছে। কিশোরী এই যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে। কিশোরীর সমর্থনে বেদে এক যুবক এগিয়ে এলে তাঁর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হয় স্থানীয় লোকজন। বেদের এত সাহস সহ্য করবে কে? বাগ্বিতণ্ডা হাতাহাতির রূপ নিলে মারতে আসা আসা এক কিশোর টাল সামলাতে না পেরে দোকানে নাশতা তৈরির ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ধাক্কা খায়। এতে ওই কিশোরের শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়।
বাঙালি সমাজপতিরা ২০১৬ সাল থেকে এমন একটা সুযোগের জন্য যেন অপেক্ষা করছিল। ওই দিন রাতে নানা সলা–পরামর্শের পর রটিয়ে দেওয়া হয়, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কিশোরটিকে বেদেরা গরম তেলের কড়াইয়ে ফেলে পুড়িয়ে মেরেছে। বেদেদের এত বড় বুকের পাটা? গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেদেপল্লিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেদেপল্লির এক নারী সংবাদমাধ্যমকে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, সোমবার দুপুরে তাঁরা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত। এ সময় শত শত পুরুষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের পল্লিতে হামলা চালায়। এ সময় তাঁরা চুলায় রান্না রেখে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রেহাই পাননি। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটের পাশাপাশি মারধর করা হয়েছে নারী-পুরুষ ও শিশুদের। নারীদের গায়ে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটিয়েছে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এলে তারা চলে যায়। ঘটনার সময়ও পুলিশ ছিল, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
এটাও কি হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচবার এই পল্লিতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে স্থানীয় লোকজনের পরিচালিত ভয়াবহ তাণ্ডবের বিচার দূরে থাক তদন্তও হয়নি এখনো। এখানকার এক সর্দার জানান, নদীমাতৃক এই দেশে তাঁরা বংশপরম্পরায় নদীতেই থেকেছেন। খাল-বিল-নদী-নালা দখল আর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের নৌকা ছেড়ে জমিনের খোঁজ করতে হচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে এ অঞ্চলে বেদেরা স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জমি কিনে বসবাস শুরু করে। এখানে পর্যায়েক্রমে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিন শতাধিক বেদে পরিবার বসতি স্থাপন করে। বেদেদের জায়গা-সম্পত্তি জবরদখল করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে নানা ছুতায় হেন কোনো কাজ নেই যে স্থানীয় কিছু লোক করছে না। তারা নানা সময় বেদে নারীদের উত্ত্যক্ত করে আসছে। বেদেপল্লিতে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশকে খবর দিয়ে হেনস্তা করা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
বেদেদের উচ্ছেদ করে তাদের জায়গাজমি হাতিয়ে নেওয়ার বহুল ব্যবহৃত এক জনপ্রিয় কৌশল ‘মাদক’ উচ্ছেদ অভিযান। ২০১৬ সালে সাতক্ষীরার লাবসা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে ইরকোন মাঠে অবস্থানরত ছিন্নমূল বেদেদের মাদক ব্যবসার অপবাদ দিয়ে উচ্ছেদের অভিযান চালানো হয়। ২০১৫ সালে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের বাঁধের গোড়ার বেদেপল্লিতেও মাদক ব্যবসার গুজব রটিয়ে তাদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক জায়গায় আবার উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা না দিলে বা দিতে দেরি করলে ভাঙচুর, মারধর এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই ঝালকাঠি শহরের কৃষ্ণকাঠি এলাকায় বেদেপল্লিতে কর্তৃত্বের জের ধরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নারীসহ ছয় জন আহত, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
উচ্ছেদ করে জমির দখল নেওয়াই মূল উদ্দেশ্য
চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে প্রায় ১৫০ বছর যাবৎ বসবাস করছে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো বেদেসমাজ। এখানে কমবেশি ২৭০ পরিবারে বসবাস। ২০১৪ সালের পর থেকে এযাবৎ বেশ কয়েকবার এই বেদেদের উচ্ছেদ করার জন্য স্থানীয় ভূমিদস্যুরা সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে হঠাৎ বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা ও চাঁদপুর মডেল থানার পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়ে ভূমিদস্যুরা বেদেপল্লিতে নতুন বসতঘর তৈরি হচ্ছে বলে তাদের উচ্ছেদ করার জন্য পুলিশকে দিয়ে অভিযান চালানোর চেষ্টা করে। সেবারের চেষ্টা সফল না হলেও ভূমিদস্যুরা হাল ছাড়েনি।
অত্যাচারের নানা রূপ
নোয়াখালীর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আরেক পুরোনো বেদেপল্লি সুনামগঞ্জের গোরারং ইউনিয়নের সোনাপুর বেদেপল্লির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর আর লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে। বিয়ের অনুষ্ঠানে নারীদের একান্ত পারিবারিক নাচের দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণের আবদার বেদেসমাজ মেনে না নিলে তাদের ওপর এই হামলা চালানো হয়। নোয়াখালী আর সুনামগঞ্জের ঘটনা শেষ পর্যন্ত পুলিশ আমলে নিয়েছে। নোয়াখালীতে তদন্ত কমিটি হয়েছে। ঘটনার সাত দিন পরে হলেও কমিটি বেদে সর্দারদের সঙ্গে কথা বলেছে, সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয় সাংসদ ৫৫ হাজার টাকার অনুদান ঘোষণা করেছেন, ভোটের বছরে এটাইবা কম কী?
লেখক: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং গবেষক।