আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ মানবমুক্তির উপায় উদ্ভাবন ও সত্য লাভের জন্য সব পার্থিব বৈভব বিসর্জন দিয়ে কঠিন সাধনার মহৎ দুঃখ বরণ করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি হয়েছিলেন মহাজ্ঞানী সম্যক সম্বুদ্ধ। তিনি ছিলেন রাজকুমার। ছয় বছর কঠোর সাধনা করে ২৯ বছর বয়সে বোধি লাভ করেন সিদ্ধার্থ। রাজপ্রাসাদ ও সোনার সংসার পরিত্যাগ করে হয়েছিলেন রাজপথের ভিখারি। কিন্তু কেন? কার স্বার্থে? আমরা ধরে নিতে পারি, নিশ্চয় জনগণের কল্যাণের স্বার্থে। কেননা, আজ গণমনে উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা—দুঃখের গোলকধাঁধা থেকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কি কোনো পথ নেই? সমাজতত্ত্ববিদ, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ মনীষীরা মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির নতুন নতুন উপায় আবিষ্কার করে চলেছেন। কিন্তু নিবেদিত, নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী মানুষ ব্যতীত কোনো মতবাদের বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব নয়। এ জন্য স্থায়ী শান্তি স্থাপনের ব্যর্থতা সমকালীন মানব–ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। তবে পরম আশ্চর্যের বিষয়, আড়াই হাজার বছর আগে মহামানব গৌতম বুদ্ধ দুঃখ–সন্তাপগ্রস্ত মানবের জন্য দুঃখমুক্তির সত্য পথ উদ্ঘাটন করে গেছেন। জনহিতার্থে ও কল্যাণে তাঁর সাধনালব্ধ জ্ঞানগর্ভ ধর্ম প্রচার করেন। বুদ্ধের ধর্মপ্রচারের পুরোভাগে ছিল মানবের দুঃখমুক্তি ও সর্বজীবে কল্যাণ। তাই বৌদ্ধধর্মকে বলা হয় মানবকল্যাণের ধর্ম।
তথাগত বুদ্ধ যে ধর্মদর্শন আবিষ্কার করে গেছেন, তা মানুষকে জাগতিক দুঃখের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃত সুখ ও শান্তির সন্ধান দেয়। চারটি সত্যের কথা ভগবান বুদ্ধ প্রচার করে গেছেন। সেই চার সত্যকে বলা হয় চার আর্যসত্য। যথা দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায়। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে আটটি পথ নির্দেশ করেছেন। সেই আট পথকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এগুলো হলো সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। বুদ্ধ প্রবর্তিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মধ্যমপন্থা। এই পন্থা একদিকে ভোগ-সুখময় এবং অন্যদিকে কঠোর তপস্যাময় জীবন থেকে সরিয়ে মানুষকে শান্তির পথে জ্ঞানমার্গে, প্রজ্ঞার পথে, বোধিলাভের পথে, পরম সুখ নির্বাণ লাভের পথে পরিচালিত করে। মধ্যমপন্থা প্রকৃতপক্ষে একটি নৈতিক বিধান, সব মানুষের কাছে যা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। সৎ জীবনাচরণের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন বুদ্ধ। সৎ জীবন এবং জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলেই মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। জগতের অনিত্যতা সম্বন্ধে অজ্ঞতা মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষা বা তৃষ্ণা সৃষ্টি করে। আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে কর্ম আর এই কর্মই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বারবার তাকে জন্মগ্রহণের প্রেরণা জোগায়। জন্ম-মৃত্যুর এই শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা যায়, যদি আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে বস্তুজগতে কোনো স্থায়িত্ব নেই, এমনকি অবিনশ্বর আত্মা বলেও কিছু নেই। তাই দুঃখমুক্তি বা নির্বাণ পূজা বা যজ্ঞের ওপর নির্ভর করে না। বুদ্ধের মতে যে পাঁচটি উপাদান দ্বারা জীব গঠিত, সেগুলো অনাত্মা (তাদের আত্মা নেই), অনিত্য (নশ্বর) এবং দুঃখের আধার। আত্মার অনুপস্থিতি যিনি উপলব্ধি করেন, তিনি জানেন, ব্যক্তি হিসেবে তাঁর কোনো অস্তিত্বই নেই। তাই পারিপার্শ্বিক বস্তুরাজির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। ইহজগতের কোনো কিছুই তাঁকে সুখ বা দুঃখ দিতে পারে না, তাই তিনি বিমুক্ত মানব, তিনি অর্হৎ।
বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম এমন এক ধর্ম, মানুষকে যা প্রকৃত সত্যের সন্ধান দেয়। এর মধ্যে অলৌকিকতার স্থান নেই, প্রকৃত সত্যকে গ্রহণ করাই হলো এর উদ্দেশ্য। সুতরাং বৌদ্ধরা বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের চিন্তা ও বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে অস্বীকার করেননি। বুদ্ধ আধ্যাত্মিক বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন সত্য, কিন্তু জাগতিক বিষয়কেও এড়িয়ে যাননি। বুদ্ধের শিক্ষায় জীবনের মূল্যবান সময়কে সঠিকভাবে পরিচালিত করার নির্দেশ রয়েছে। তিনি মানবকল্যাণেও আত্মোৎসর্গ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বন্ধুবান্ধব, জাতি এবং বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব অপরিসীম। সুতরাং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বৌদ্ধদের ওপর আরোপিত কর্তব্য ভুলে গেলে চলবে না। নিজ নিজ সাধ্যমতো বিশ্বের কল্যাণে প্রত্যেক বৌদ্ধের কাজ করে যাওয়া উচিত। সরকার আরোপিত যুক্তিসংগত আইনকানুনের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ বুদ্ধ করেননি। সমাজের ঐতিহ্য, আচরণ, মানবকল্যাণপন্থী অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধেও তিনি কোনো আপত্তি তোলেননি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়েও হস্তক্ষেপ করেননি বা আদেশ-উপদেশ দেননি। যদিও অনেক রাজা, মহারাজা, মন্ত্রীও তাঁর অনুরাগী ছিলেন।
বৌদ্ধ সেই ধর্ম, মানুষকে যা পরার্থে নিমগ্ন হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়, মানবকল্যাণে ব্যক্তিগত সুখকে বিসর্জন দিতে শিক্ষা দেয়। স্বেচ্ছায় ধর্মীয় নীতিমালা ও নিয়মকানুন পালনের জন্য উৎসাহিত করে। ওপর থেকে চাপানো কোনো অনুশাসন এখানে নেই। এসব নীতি অনুসরণ করে পরিপূর্ণ ও সৎ হওয়ার সুযোগ পায় মানুষ, শান্তিময় জীবনযাপনে অপরকে সাহায্য করতে সমর্থ হয়। জীবনের পূর্ণতাই মুক্তির একমাত্র লক্ষ্য।
ত্রিস্মৃতিবিজড়িত আজকের এই শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার পবিত্র দিবসে আমাদের আকুল প্রার্থনা, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস থেকে সমগ্র পৃথিবী মুক্ত হোক। সব মানুষের জীবন হোক সুস্থ, সুন্দর, মসৃণ ও নিরাপদ। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে সব ধরনের যুদ্ধ, সংঘাত ও হানাহানি বন্ধ হোক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।
শান্ত হে মুক্ত হে
হে অনন্ত পুণ্য
করুণা ঘন ধরনীতল
কর কলঙ্কশূন্য।
জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।
● ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ, ঢাকা, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার; সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন; সংগঠক, লেখক ও প্রাবন্ধিক