সরকারি কোনো অনুষ্ঠানকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করে তোলা উচিত না অনুচিত, এ নিয়ে ভারতের মানুষ আর বিশেষ মাথা ঘামায় না। ভারতের সর্বেসর্বা নির্বাচন কমিশনও রা কাড়ে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাই তাঁর সাম্প্রতিক সরকারি সফরকে নির্ভেজাল নির্বাচনী সফরে পরিণত করলেন। বিহারের আরা জেলায় এক জনসভায় ভাষণ দিতে দিতে রাজ্যের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করলেন এমন ঢঙে, যেন উৎফুল্ল জমিদার বাৎসরিক কাঙালিভোজন করিয়ে তৃপ্ত হচ্ছেন। অথবা দাতা কর্ণ সব বিলিয়ে ফকির হতে এসেছেন।
লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদি বিহারে প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, রাজ্যের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ সাহায্য দেওয়া হবে। ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মাথায় সেই সাহায্যের পরিমাণ আড়াই গুণ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে মোদি যা বললেন, তার মোদ্দাকথা, বিহারে জঙ্গলের রাজত্বের দিন শেষ করে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে তিনি নিজের কাছেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই শিক্ষা, সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য এই বিপুল সহায়তা।
মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার প্রধানমন্ত্রীর ‘বিহার-প্যাকেজের অসারত্ব’ ব্যাখ্যায় সময় নষ্ট করেননি। তাঁর মতে, যেসব প্রকল্পে মোদি অর্থ বরাদ্দের কথা জানিয়েছেন, সেগুলোর অধিকাংশই পূর্বঘোষিত। অর্থাৎ মোদির ঘোষণা ভাঁওতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাজ্যবাসী এত বোকা নয় যে মোদির চোখ দিয়ে তারা রঙিন বিহারের স্বপ্ন দেখবে।
বিজেপি বিহার-জয়ে ব্যর্থ হলে মোদি-শাহ জুটির ওপর মারাত্মক প্রশ্নচিহ্ন আঁকা হবে। দিল্লির ভোটে গোহারা হারার
পর যে অসন্তোষ দানা বেঁধেও মিলিয়ে গিয়েছিল, বিহারে ব্যর্থ হলে সেই অসন্তোষই তীব্রতর হয়ে উঠবে। দাবি উঠবে অমিত শাহর অপসারণ।
তেমন হলে দল ও সরকারেও মোদির রমরমা কমতে বাধ্য। প্রায় বিনা বাধায় সবাইকে তুচ্ছ করে মোদি এককভাবে দল ও সরকার চালাচ্ছেন, বিহারে হারলে সেই দাপট উধাও হয়ে যাবে। কারণ, ২০১৬ সাল মোদিকে তেমন কিছু দিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও তামিলনাড়ু বিধানসভার ভোটে বিজেপির সম্ভাবনা প্রায় কিছুই নেই।
আসামেও আগামী বছর ভোট। সেখান থেকে বিজেপিকে খালি হাতে ফিরতে হবে না ঠিকই, কিন্তু সরকার গড়তে পারবে কি? কাজেই বিহারেই হতে চলেছে মোদি-শাহ জুটির অগ্নিপরীক্ষা। অবশ্য বিহার জিতলে ২০১৬-কে মোদি-শাহ জুটি খানিক উপেক্ষা করে ২০১৭-র দিকে নজর নিবদ্ধ করতে পারবেন। ওই বছরেই আসল যুদ্ধ। উত্তর প্রদেশ। উত্তর প্রদেশের নির্বাচন মোদির ঘাড়ে ডেমোক্লিসের খাঁড়া।
বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে লড়েছিল মোদিকে সামনে রেখে। দেখা যাচ্ছে, তাতে তারা বিভিন্ন রাজ্যে যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিল, পরবর্তী রাজ্য বিধানসভার ভোটে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার অনেকটাই কমে গেছে। মনে রাখতে হবে, মোদিময় লোকসভা ভোটের মোটামুটি এক বছরের মধ্যেই ঘটে গেছে এই রাজ্যগুলোর বিধানসভার ভোট। এবং এই সময়ের মধ্যেই ভোটের হার কমেছে।
এই অবস্থায় বিহারের নির্বাচন। লোকসভায় বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। বিজেপি পেয়েছিল ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। এবার লড়াই মূলত দুই শিবিরে। বিজেপি ও রাম বিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টির সঙ্গে এই নির্বাচনে হাত মিলিয়েছেন তিনি, নীতিশ কুমার যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন এবং পরে সেই পদ থেকে সরিয়ে নিজে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন। জিতেন রাম মাঝি। এই পোড় খাওয়া প্রবীণ তফসিল শ্রেণির প্রতিনিধি। বিহারের জাতপাতসর্বস্ব রাজনীতিতে একজন মাঝারি মাপের নেতা। নীতিশের কাছে অপমানিত হয়ে নতুন দল গড়েছেন, হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা (হাম)। রাজ্যের মগধ এলাকায় জিতেন রামের প্রভাব ভালোই। বিজেপির জোটে রয়েছে উপেন্দ্র কুশওয়ার দল রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টিও।
কুশওয়া মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য। তিনিও পিছিয়ে পড়া সমাজের নেতা। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো ভোট এই দুই ছোট দলের রয়েছে। শুধু বর্ণহিন্দু সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ভোটে জিততে বিজেপি এভাবেই একটা ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর রাস্তায় হাঁটতে চলেছে। বলা উচিত, জাতপাতনির্ভর বিহারি রাজনীতিতে বিজেপির এই চালে মেওয়া ফলতে পারে।
এই জোটের বিপরীতে মোদির প্রধান চ্যালেঞ্জার নীতিশ কুমার ও লালু প্রসাদ যাদব। দুজনেই জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের ফসল। দুজন কেন বলি, এনডিএ ক্ষমতায় এলে মোদি যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করবেন, সেই সুশীল মোদিও জয়প্রকাশের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই লালু-নীতিশদের পাশে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীকালে লালু-নীতিশের মধ্যে সম্পর্কটা দাঁড়ায় সাপে-নেউলের।
কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যে কিছুই হয় না, এই দুজন আবার তা বোঝালেন। ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার হারানো লালু বাড়ালেন তাঁর বন্ধুতার হাত। তা ধরতে দ্বিধা করলেন না বিজেপির ঘর ছেড়ে আসা নীতিশ। বিহারে কংগ্রেসের সূর্য আজ বহুদিন অস্তমিত। তবু নেই নেই করেও কংগ্রেসের যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা লালু-নীতিশের কাছে অনেক। বিজেপির বিরোধিতায় এই তিনের চ্যালেঞ্জ শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়ায়, সেটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জল্পনা। এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে বলা যায়, পাল্লাটা সামান্য হলেও বিজেপি জোটের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।
তবে কতগুলো ছোট ছোট ‘কিন্তু’ রয়েছে। এই ভোটে এই ছোট কিন্তুগুলো শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে উঠতে পারে। যেমন শারদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)। ২৪৩ আসনের রাজ্য বিধানসভায় লালু ও নীতিশ ১০০টি করে আসনে লড়বেন, কংগ্রেস লড়বে ৪০টিতে। এনসিপির দাবি ছিল ১২টি আসন। তাদের জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে মাত্র তিনটি। এনসিপি শেষ পর্যন্ত আলাদা লড়লে বিজেপির লাভ।
দ্বিতীয় কিন্তু প্রশাসনিক সহায়তা। নীতিশ সরকার ক্ষমতায় আছে ১০ বছর। ভোটের সময় শাসক দল সব সময়ই প্রশাসনিক সহায়তা কিছুটা পেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও নীতিশ তা পাবেন।
তৃতীয় কিন্তুটা লালু-নীতিশদের কাছে একটা বড় চিন্তা। প্রধানত যাদব-কুর্মি-মুসলমানদের বিপুল সমর্থন এবং প্রশাসক হিসেবে নীতিশের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি লালু-নীতিশের প্রধান হাতিয়ার। মুসলমানদের সেই সমর্থনে ঘা মারতে এগিয়েছেন মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) নেতা লোকসভা সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসি।
হায়দরাবাদে আবদ্ধ না থেকে ওয়াইসি তাঁর দলকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। মহারাষ্ট্রে বিধানসভায় তাঁরা এ বছরেই প্রথম প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। এবার নজর বিহারের সীমান্ত এলাকার চার জেলায়। কাটিহার, পূর্ণিয়া, আরারিয়া ও কিষেনগঞ্জে মুসলমান জনসংখ্যা বিপুল। এই চার জেলার হাত উপুড় করা সমর্থন লালু-নীতিশের মাছের চোখ। সেখানে ওয়াইসির মিম অন্তত ৩০টি আসনে কতটা দাঁও মারবে, তার ওপর নির্ভর করবে দুই পক্ষের হারা-জেতা। ওয়াইসি বিজেপির পালের বাড়তি হাওয়া। ওয়াইসিকে তারা বেশ তোল্লাও দিচ্ছে। অথচ এই ওয়াইসি দীর্ঘদিন ধরেই ছিলেন কংগ্রেসের দোসর। অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা হওয়ার দিন থেকেই ওয়াইসির দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চলে যায়।
চতুর্থ কিন্তুটা আরজেডি ও জেডি (ইউ)-এ ভাঙন। ফি দিনই কেউ না কেউ এই দুই দল ছেড়ে হয় বিজেপি নতুবা তার সহযোগী দলে যোগ দিচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন মোদি-মাহাত্ম্যের জয়গান করে, কেউ মানতে পারছেন না লালু-নীতিশের বন্ধুতা। ভোটের আগে এই হাওয়া অনেক কিছুই বুঝিয়ে দেয়।
এই চার কিন্তুর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আশঙ্কা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ২০১৩ সালে নীতিশের বিজেপি জোটত্যাগের পর রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা মারাত্মক বেড়ে গেছে। ২০০৫ সালে নীতিশ মুখ্যমন্ত্রী হন। সেই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত রাজ্যে ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনা ঘটেছিল মাত্র ৪৭টি। অথচ ২০১৩ সালের জুনের পর থেকে এযাবৎ হানাহানি, প্রাণহানি ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২০০টি।
উন্নয়ন ও সুশাসনের উদাহরণ রেখে বিহারকে উন্নত রাজ্যের সোপানে প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি নীতিশ কুমার রেখেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল তা বানচাল করে দিতে পারে। বিহারের ভোট শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের লড়াই হয়ে দাঁড়ালে তা হবে নিতান্তই দুর্ভাগ্যের।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।