বিষণ্নতা আর বিরক্তির শহরে আবার নির্বাচন
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আনন্দ-ভৈরবী’ কবিতায় বলেছেন, ‘যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর’। সত্যিই কি তাই? এক ফাঁপা অন্তঃসারশূন্য শহরে বসবাসই কি আমাদের নিয়তি? যাপিত জীবনের উপলব্ধি এখানে কোথায়? কোথায় দর্শন? বসবাসের গভীরতা? শহর নাকি কাঁদে; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে; মেট্রোপলিস থেকে এই ঢাকা ক্রমশ যেন রূপান্তরিত হচ্ছে নেক্রোপলিসে—সিটি অব ডেথ—মৃতের শহরে; জীবন্ত মানুষের ভাগাড়ে; এ শহর যেন এক নোংরা-ময়লা রুমাল। এর প্রাণ কোথায়? কোথায়বা প্রাণভোমরা? যেন ইস্পাত-কঙ্কাল।
অখণ্ড ঢাকা আজ দ্বিখণ্ডিত। মানুষ এই নগরে থাকে কিন্তু তাদের নেই কোনো নাগরিক মর্যাদা বা অধিকার। বিভিন্ন জরিপ আর আন্তর্জাতিক সূচকে ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর অন্যতম। পৃথিবীর সব শহরেরই নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে। ইচ্ছা করলেই এক সিটির মতো আরেক সিটি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ঢাকার নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। ঢাকার সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে আছে কি কারও মনোযোগ? এ এক স্থবির শহর। ২০ মিনিটের পথ মানুষকে ২ ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হয়। গাড়ি চলে না। মানুষ তাই চলমান, আলোকিত আর গতিশীল ঢাকা চায়। দুর্নীতিমুক্ত আর সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিটি প্রশাসন চায়।
দুই কোটি মানুষের ঢাকা নগরীতে সমস্যার অন্ত নেই। ঢাকা শহরের প্রধানতম সমস্যা যানজট থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চায় মানুষ। এ জন্য রাজধানীতে সহজ যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। দ্রুত কম খরচে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া সব থেকে জরুরি। ঢাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে বর্জ্য-আবর্জনায়। এখানে মানুষের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রতিদিন কয়েক হাজার টন বর্জ্য রাস্তায় খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা খুবই করুণ। মশার উৎপাতে জনজীবন অতিষ্ঠ; ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়ায় বহু সম্ভাবনাময় প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। নির্বাচিত মেয়র আর কাউন্সিলররা মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন সর্বতোভাবে।
পরিবেশদূষণ ভয়াবহভাবে প্রভাব ফেলছে ঢাকাবাসীকে। সবার প্রত্যাশা, ঢাকাকে মানবিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানুষ নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছ থেকে একটি নিরাপদ ঢাকা উপহার চায়। সবাই চায় একটি গ্রিন ঢাকা, চায় ক্লিন ঢাকাও বটে। পরিষ্কার, বর্জ্যমুক্ত ঢাকা। তরুণেরা রাস্তায় সাইকেল চালাতে চান। বয়স্করা স্বাভাবিকভাবে সড়কে হাঁটতে চান। নারীরা নিরাপদ ট্রান্সপোর্ট চান। ঢাকায় কয়েক লাখ পোশাককর্মী নারী। বাসে উঠতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নারীদের। তাঁদের জন্য কোনো ভালো যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। সর্বস্তরের জনগণের জন্য বিনোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকাবাসীর মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা একটি অন্যতম বিষয়। কী খাচ্ছি আমরা? সবকিছুই বিষে ভরা। এর কি প্রতিকার হবে? প্রতিবিধান?
অনেক জায়গায় গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। মেয়ররা কি এসব সমস্যা সমাধান করতে ভূমিকা রাখতে পারেন? ওয়ার্ডগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংকট রয়েছে। খেলার মাঠ সব কিশোরের দাবি; কিন্তু ঢাকা থেকে খেলার মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক লাখ লোক কাজের জন্য রাস্তায় নেমে পাবলিক টয়লেট পায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশ ঢাকায় হারিয়ে গেছে। এই রুক্ষতা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি চায়। এ থেকে মুক্তি পেতে ঢাকাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সবার জন্য বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার জরুরি। কয়েক লাখ বস্তিবাসীর জন্য কী করা যায়, আলাদা করে ভাবতে হবে তা নিয়েও। গৃহহীন মানুষের জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকায় কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় ঘোরে, রাস্তায় ঘুমায়।
ঢাকার নাগরিকেরা নিয়মিত কর পরিশোধ করছেন। অথচ তাঁরা নাগরিক সেবা সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। নানা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। ঢাকার উন্নয়নে ভোটারদের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের ‘বিশ্বাসযোগ্য কমিটমেন্ট’ থাকতে হবে। সেবা খাতগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আধুনিক নগরায়ণের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজে কিছু পাওয়ার জন্য নয়, বরং সেবার মনোভাব নিয়ে ইতিবাচকভাবে কাজ করতে পারলে ঢাকার উন্নয়ন সম্ভব। ঢাকাকে উন্নত বিশ্বের শহরগুলোর মতো সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির বৃত্তাবদ্ধ চক্র থেকে মুক্তি চায় মানুষ। আটপৌরে গতানুগতিকতায় মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে, এর আশু অবসান দরকার। মানুষ সত্যি সত্যি পরিবর্তন চায় এবং আমরা মনে করি পরিবর্তন সম্ভব। আর এখন মানুষের আশা-প্রত্যাশা জমে হাজার গুণ বেড়ে গেছে। মান্যবর মেয়র প্রার্থীরাও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বিস্তর। স্বপ্ন দেখানো ভালো, যদি না তা দিবাস্বপ্নে পর্যবসিত হয়!
রোবায়েত ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক