প্রায় ১৬ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমিক কাউন্সিল তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তে বলেছিল, কোটা সিস্টেম চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ওই সিদ্ধান্তের পর কার্যত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাতে ভর্তি বন্ধ রয়েছে বলে আমরা জানতে পারি।
কোটায় ভর্তিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন মানসম্মান রক্ষায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ঠিক একই সময়ে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য করা পোষ্য কোটায় ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ থেকে ৩০ করা হয়েছে, কোথাও কোথাও সেটিও কমিয়ে ২৫ নম্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই ভর্তি পরীক্ষায় যাঁরা ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা তার দ্বিগুণ বা তিন গুণ নম্বর পেয়েও সুযোগই পাচ্ছেন না। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে ০ দশমিক ২৫ নম্বর কম পাওয়ার কারণে মেধাতালিকায় নামই তুলতে পারছেন না।
অথচ ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পরও কেবল বাবা-মায়ের কর্মক্ষেত্রের সুযোগে তাঁদের সন্তানেরা অনায়াসে ভর্তি হতে পারছেন। কোনো কোনো প্রভাবশালী শিক্ষকের সন্তান যদি ভর্তি পরীক্ষায় পাসও না করেন, তাঁদের জন্য বিশেষ একাডেমিক সভা ডেকে পাস নম্বর কমিয়ে নয়া আইনের মাধ্যমে সেই ছেলেমেয়েদের ভর্তি করিয়ে ছাড়ছেন, এমন খবরও গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই।
দেশের সিংহভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য কোটার মারপ্যাঁচে ‘পোষ্য কোটা’ দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ঠিক কোন যুক্তিতে, কোন আইনের বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরিরতদের সন্তানদের এই ‘অনৈতিক’ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তার কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নেই। বরং পোষ্য কোটায় আসা এই সব ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করে সেখানেই শিক্ষক হচ্ছেন, কর্মকর্তাও হচ্ছেন। যে কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পরিবারতন্ত্রের কবলে পড়েছে। মা বা বাবা শিক্ষক হওয়ার সুযোগে সন্তান পোষ্য কোটায় ভর্তির পর চাকরিটাও বাগিয়ে দেওয়া যেন সেই সব অভিভাবকের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
এই সংস্কৃতির কবলে পড়ে আমাদের দেশের অনেক ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ আসন পোষ্য কোটায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মূল বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ না করলেও এই পোষ্য কোটায় ভর্তি করানোর প্রক্রিয়াটি সারছে রাতের অন্ধকারে, যাতে কেউ বুঝে উঠতে না পারে। লোকচক্ষুর অন্তরালে হওয়া এসব ভর্তিতে যেমন অস্বচ্ছতা থাকছে, তেমনি প্রতিবছর এই পোষ্য কোটায় কতজন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন, তা-ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক হিসাব-নিকাশে আসছে না। এই পোষ্য কোটায় ভর্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গণমাধ্যমের কাছে তথ্য দিতেও অনীহা দেখেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, এই রাষ্ট্র কেন আপনার সন্তানদের ভর্তির জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করে দেবে? একজন সাধারণ কৃষক কিংবা রিকশাচালকের ছেলেমেয়ের সঙ্গে আপনার ছেলেমেয়ের প্রতিযোগিতা করতে সমস্যা কোথায়? একজন স্কুলশিক্ষক কিংবা কলেজশিক্ষকের ছেলেমেয়ে আপনার ছেলেমেয়ের চেয়ে বেশি নম্বর ভর্তি পরীক্ষায় পাওয়ার পর কেন ভর্তি হতে পারবেন না? কেন অভিভাবকের কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তাঁদের সন্তানেরাই উচ্চশিক্ষায় পড়াশোনার সুযোগ পাবেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি সাধারণ জনগণের ‘করের’ টাকায় চলে, তাহলে ভর্তিতে সম-অধিকার বলবৎ থাকবে না কেন?
যোগ্যতার মাপকাঠির বদলে পোষ্য কোটার এ সুযোগের মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের ‘কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে গড়ে তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিজীবীরা। সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতার সূক্ষ্ম অপপ্রয়োগের মূলমন্ত্র বপন করে দিচ্ছেন। ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া আপনার সেই সন্তানই বিভাগে আবার কথিত ‘ভালো রেজাল্ট’ করে সেখানেই থিতু হচ্ছেন। ফলে ‘যোগ্যতাহীন’ মানুষদের একটি বলয় বেড়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আমি মনে করি, যোগ্যতার মাপকাঠির বদলে পোষ্য কোটার এ সুযোগের মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের ‘কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে গড়ে তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিজীবীরা। সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতার সূক্ষ্ম অপপ্রয়োগের মূলমন্ত্র বপন করে দিচ্ছেন। ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া আপনার সেই সন্তানই বিভাগে আবার কথিত ‘ভালো রেজাল্ট’ করে সেখানেই থিতু হচ্ছেন। ফলে ‘যোগ্যতাহীন’ মানুষদের একটি বলয় বেড়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
উচ্চশিক্ষালয় হচ্ছে মানসিক বিকাশের আঁতুড়ঘর। এখানে আপনার মানবিক গুণের পাশাপাশি নিজেকে আগামী দিনের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলা দায়িত্ব হয়ে ওঠে। অথচ শুরুতেই আপনার সন্তানকে ‘অনৈতিক’ সুযোগ নেওয়ার দীক্ষা দিয়ে আপনি উচ্চ শিক্ষালয়ে পাঠাচ্ছেন, আরেকজনকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ‘নৈতিক বিবেকবান’ হওয়ার মন্ত্র জপছেন, যা কখনোই সভ্য সমাজে দেখা যায় না। উদারনৈতিক ও শিক্ষাবান্ধব দেশগুলো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনোই বাবা-মায়ের চাকরির সুবিধা তাঁদের সন্তানদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ দেয় না। বরং বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার পর তাঁর অধীনে ডজন ডজন ছেলেমেয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও তাঁর সন্তানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় কড়া নাড়তে পারেন না। সন্তানদের যোগ্যতা না থাকলে সেখানে কখনোই বাবা কিংবা মা নিজ ক্ষমতাবলে তাঁদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান না। অথচ আপনার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বসার আগেই জেনে গেছেন, তিনি যদি ভর্তি পরীক্ষায় খারাপও করেন, পোষ্য কোটায় ঠিকই তাঁর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক এই চিন্তাচেতনা যখন আপনার সন্তানের মনে তৈরি হয়, ঠিক সেই সন্তানের পক্ষে শক্ত প্রতিযোগিতায় যেমন অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ভালো মানুষের সমাজে অবদান রাখাও কঠিন হয়ে যায়। যদিও এই সংখ্যা কম, তবে ‘পোষ্য কোটার’ অভিশাপ কখনোই আমাদের সম্মানিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা অনুভব করতে পারেন না।
একটি দেশের সুষম উন্নয়নের জন্য সব ধরনের জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়া রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব। সুশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশের জন্য উপযুক্ত জনগোষ্ঠী তৈরি করে দেওয়ার সেই কাজই করে থাকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে পাহাড়ি, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটানোর মধ্যে যৌক্তিকতা আছে। এর মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার আলো আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা অর্জনে এমন কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে।
তবে সুষম সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগী হিসেবে তৈরি না করে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা-মায়ের প্রতিষ্ঠানে ‘পোষ্য কোটার’ প্রদর্শনী উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড রক্ষার অন্তরায় বটে। পোষ্য কোটা ভর্তি বন্ধ রেখে আপনি যদি আপনার সন্তানকে সামনের দিনের জীবনযোদ্ধা হিসেবে তৈরি করেন, তাহলে সেই ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য পৃথিবীটা অনেক পবিত্র মনে হবে, হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত থাকবে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকার দেশে ৪৬ বছরের অধিক সময় সরকারি চাকরিগুলোতে কোটা ব্যবস্থা চালু রেখেছিল। একসময় নারীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ ছিল, দেশে এখন নারীরা এগিয়ে গেছেন, আদিবাসীরা সুশিক্ষা নিয়ে গর্বের সঙ্গে চাকরি করছেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও চাকরি নিয়ে তাঁদের দুঃখ মোচন করছেন। নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ কর্মক্ষেত্রকে কর্মচঞ্চল করে চলেছে। আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় সুস্পষ্ট হচ্ছে, কোটা প্রথার সঠিক ফলাফল অর্জন বেশ কয়েক বছর আগেই অর্জিত হয়েছে।
আর এসব দিক বিবেচনায়, দেশে তরুণদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছর আগে সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে। ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতেও কোটা চালু রাখা কিছুতেই জুতসই যুক্তি হতে পারে না।
পোষ্য কোটার অজুহাতে অদক্ষ ও অযোগ্যদের সুযোগ করি দিয়ে মেধাবীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটার এই সংস্কৃতি দেখতে চাই না। এই অভিশাপ থেকে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষালয় কেবল কাগুজে সনদ অর্জনের স্থান নয়, এটি একটি জাতি গঠনের প্রশিক্ষণ মাঠ। এখানে অনৈতিক সুযোগের স্থান থাকবে না, থাকবে কেবল সুস্থ মস্তিষ্কের বিকাশ। আমার বিশ্বাস, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে পোষ্য কোটা যুগের অবসান ঘটবে।
ড. নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক