সারা বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থার মান নির্ধারণ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ড আছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি)। অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকেই এটি প্রচলিত আছে। আমরা পিছিয়ে ছিলাম। বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইকিউএসি চালু করা হয়। এটি এত দিন ছিল সরকারের উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) তত্ত্বাবধানে। এ বছর রাজস্ব খাতে চলে এসেছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা আইকিউএসি চালু করেছি। প্রাথমিকভাবে কোর্স কারিকুলাম এই নিয়ম মেনে করতে বলেছি।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে একটি কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল। এই সেল উপাচার্যের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে একজন পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক দ্বারা। এতে শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থী সবাইকে সম্পৃক্ত করা হবে। এই সেল মূলত তিনটি কাজ করবে: ১. শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ কতটা মানসম্মত ও কার্যকরী, তা দেখবে। শিক্ষক কীভাবে পড়াচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিতে পারছে, এসব দেখবে। ২. বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে কি না, হলে গবেষণার গুণগত মান রক্ষা করা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করবে। ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে।
প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নিশ্চিত করার কিছু পদ্ধতি আছে। আগে ছিল সিলেবাস, এখন বলা হয় কারিকুলাম। সিলেবাস আর কারিকুলামের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য আছে। কী পাঠদান হবে, তা–ই সিলেবাস। আর একটি বিষয় পড়ানো হবে, সেটি কেন পড়ানো হবে, পড়লে ছাত্রছাত্রীরা কী শিখবে, এর ব্যবহারিক দিক আছে কি না—এসবও দেখা হয় কারিকুলামে। সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম, শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমও এর অন্তর্ভুক্ত। আগে এসব বিষয়ে তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। শিক্ষক ক্লাসে এসে বক্তৃতা দিয়ে চলে যেতেন। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি কতটুকু আত্মস্থ করল, তা দেখার বালাই ছিল না। এখন আইকিউএসি এসব বিষয় মনিটর করবে।
শিক্ষকদের গবেষণার মান ঠিক আছে কি না, দেশে-বিদেশে মানসম্মত জার্নালে গবেষণা প্রকাশিত হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় যাচাই করে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য কতগুলো কমিটি থাকবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এসব দেখবেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। ক্লাসে গিয়ে দেখা হবে পাঠদানের পদ্ধতি ঠিক আছে কি না। ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ আছে কি না, প্রশাসন ঠিকমতো চলছে কি না, তা-ও দেখা হবে।
কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে দেখা হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত আসছেন কি না, দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছেন কি না। ডকুমেন্টেশন হচ্ছে কি না, তা–ও দেখা হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পর্যন্ত নেই। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার নেই, ডিন নেই। এগুলো মানসম্মত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাপকাঠির মধ্যে পড়ে না। এসব বিষয়ও তদারকি করবে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল।
ছাত্রছাত্রীরাও বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। টিচিং অ্যান্ড লার্নিংয়ের প্রথম ধাপেই তারা। কোর্স শেষে তাদের একটি ফরম পূরণ করতে দেওয়া হবে। ধরা যাক, কেউ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। প্রথম বর্ষে যা যা পড়ে এসেছে, এতে তার মধ্যে কী কী পরিবর্তন এসেছে, কতটুকু উন্নতি হয়েছে, প্রতিটি বিষয় ধরে ফরমে এসব তথ্য পূরণ করবে। ছাত্রছাত্রীরা জানাবে কোর্সটি কতটা কার্যকর ছিল, কিংবা এটি না থাকলেও চলত কি না। সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম আছে কি না, খেলাধুলা, সংগীত, বিতর্ক ঠিকমতো হয় কি না, সেমিনার ঠিকমতো হয় কি না, প্রতিটি বিষয় দেখা হবে। ছাত্ররা ফিল্ড ভিজিট করছে কি না, ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট করছে কি না—সবই এর অংশ। অ্যালামনাইদের মতামত নেওয়া হবে, চাকরিদাতাদের অভিমত চাওয়া হবে। সুতরাং সেলের কাজ বহুবিধ।
শিক্ষা গুণগত মানসম্পন্ন না হলে তা কাজে আসে না। বিশ্বমানের শিক্ষা দিতে হবে, সেই শিক্ষাপদ্ধতি ও কারিকুলাম তৈরি করতে হবে এবং সেটাই সেল নিশ্চিত করবে। ধরা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র রসায়নে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করল। কিন্তু রসায়নের আধুনিক উদ্ভাবন, নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে তার ধারণা নেই। এমনটি হলে তো চলবে না।
একটি প্রতিষ্ঠানকে আইএসও সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষ এসে দেখে সেটি সব নিয়ম মেনে চলছে কি না, সঠিক ফর্মুলা ও ইথিকস মানছে কি না, গুণগত মান ঠিক থাকছে কি না। এই রকমভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আইএসও সার্টিফিকেটধারী হতে হবে। বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইএসও সার্টিফায়েড। তাদের সনদ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে গ্রহণযোগ্য। আমরা যেমন খাবার কিনতে গেলে বলি অমুক কোম্পানির খাবার ভালো। আবার বাজারে নতুন কিছু এলে চিন্তা করি, নেব কি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায়ও বিষয়টি সে রকমই। অদূর ভবিষ্যতে চাকরির ইন্টারভিউতে বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বলা হবে, বিশ্ববিদ্যালয়টি আইএসও সার্টিফায়েড, সুতরাং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রগণ্য। আমরা যেভাবে এগোচ্ছি, তাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বিভিন্ন ক্যাটাগরির র্যাঙ্কিংপ্রাপ্ত হবে। এ ধরনের সনদ প্রদানের জন্য সরকার ইতিমধ্যে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করেছে এবং তা সম্প্রতি এর কার্যক্রমও শুরু করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা পাঠদানে সিরিয়াস নন। গবেষণাও করেন না। এতে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ আসবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে। বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ না করলে চাকরি যায় না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মমুখী করা সেলের কাজ। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঠিকমতো পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকল পর্যায়েই অ্যানুয়াল প্ল্যান অব অ্যাকশন (এপিএ) কার্যকর করা অতি জরুরি।
আইকিউএসির প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করা, সনদপ্রাপ্তদের সমাজে ও চাকরির বাজারে যোগ্যতম ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলা এবং শিক্ষায়তনকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করা। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এসব জরুরি। আশা করি, আইকিউএসি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমূল বদলে দেবে ।
ড. এস এম ইমামুল হক : বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য