একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অধিকতর খারাপ অবস্থায় বাংলা ১৪২৮ সন শেষ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসঙ্গে যত সমস্যা তাঁকে ঘিরে ধরেছে, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে এমনটা দেখা গিয়েছিল। সে সময় আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে অনেক তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। এরপর নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ভালো ফল এবং তারপর তৃণমূলের অনেক নেতা–নেত্রীর বিজেপিতে যোগ দেওয়া মমতার সমস্যা বাড়িয়েছিল।
যদিও ২০২১ সালে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসা মমতা বিরোধীদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। গত এক বছরে কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে তৃণমূল, জিতেছে একের পর এক উপনির্বাচন বা পৌরসভা। ধারাবাহিক জয়ই বিপদে পরিণত হয়েছে। মমতার এখন প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ, দলের ভেতরে বাদানুবাদ, মারধর এবং খুনোখুনি নিয়ন্ত্রণ করা। প্রথমে যখন নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল এটা ইচ্ছা করেই করানো হচ্ছে, যাতে দলের সব গোষ্ঠীকে চাপে রাখা যায়।
গত দুই মাসে অন্তত ২০টি রাজনৈতিক হত্যা পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা অন্য রাজ্যের থেকে এখানে নানা ইতিহাসগত কারণে বেশি। কিন্তু তৃণমূল আমলে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা নিজের সহকর্মীকেই হত্যা করছেন। বীরভূম জেলার একটি পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ কিছুদিন আগে খুন হয়েছেন। তৃণমূলেরই নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য, টাকাপয়সার ভাগ-বাঁটোয়ারার জেরে ভাদুকে খুন করেছেন আরেক নেতা। কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের যেকোনোটিতে কান পাতলে শোনা যাবে তৃণমূলের এক নেতার সঙ্গে আরেক নেতার বিরোধের কাহিনি।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিরোধের মূলে রয়েছে জমি, সম্পত্তি ও বড়সড় নির্মাণ বাবদ আদায় করা টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা। কারণ হিসেবে দক্ষিণ কলকাতার এক নেতা বললেন, ‘১০ জন নেতার ১০ জনই যদি তৃণমূলের হয়, তবে তৃণমূলই তৃণমূলকে মারবে। সেটাই স্বাভাবিক।’ দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ‘আনুষ্ঠানিক খাত’–এ কোনো চাকরি নেই, রাজনৈতিক দল করাটাই এখন চাকরি। রাজনীতি সরাসরি মানুষের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক বেশি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ও সহিংস হয়ে উঠেছে। কোনো জমি বা নির্মাণ প্রকল্পের দখল নিতে একসঙ্গে ১০টি গোষ্ঠী ঝাঁপাচ্ছে, মারধর করছে।
এর পাশাপাশি যেটা মমতার বরাবরের সমস্যা, সেটা হলো বেফাঁস মন্তব্য। চাপের মুখে তিনি অতীতেও বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, এবারও একটি ধর্ষণের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, ধর্ষণের শিকার নারী ‘অন্তঃসত্ত্বা ছিল’ বা ‘তাঁর অন্য কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল’ কি না, তা নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ, যাদের ভোট কম কিন্তু চিৎকার করার ক্ষমতা বেশি এবং সংখ্যালঘু সমাজের একটা অংশ তৃণমূলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে
তবে এটা তৃণমূলের একমাত্র সমস্যা নয়। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট প্রায় সব আলোচিত মামলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছেন। যার অর্থ, রাজ্য প্রশাসনের তদন্তের ওপর আদালত তথা সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। একে পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক ব্যর্থতা বলে প্রচার করে রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসনের দাবি তুলছে বিজেপি। এভাবে লাগাতার মামলা কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে চলে যাওয়া যে ভবিষ্যতে (বিশেষত নির্বাচনের সময়ে) মমতার ওপর চাপ বাড়াবে, তা বলাই বাহুল্য।
মনে রাখা প্রয়োজন, তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই এখন কোনো না কোনো মামলায় জড়িয়ে রয়েছেন। বেশির ভাগই ব্যক্তিগত দুর্নীতির মামলা। কোনোটির সঙ্গে কয়লা পাচারের সম্পর্ক রয়েছে, কোনোটির সঙ্গে গরু চোরাচালানের। এ ছাড়া তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্যের অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন হচ্ছে, বর্তমানে অভিযোগের তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন হাইকোর্ট। পুলিশ প্রশাসনসহ নিম্নপদের সরকারি নিয়োগ করতে তৃণমূলের নেতারা যে টাকা নিয়ে থাকেন, এটা পশ্চিমবঙ্গে ‘ওপেন সিক্রেট’। এ ছাড়া একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলা রয়েছে।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে উপনির্বাচনে মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিলেও, দ্রুত তাঁদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হচ্ছে। এক বছর আগে তৃণমূল বিরাটভাবে জয় পাওয়ার পর, এখন মনে হচ্ছে দুই বছর পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ২০১৯-এর মতোই আবার ভালো ফল করবে। সেবার বিজেপি ৪২-এর মধ্যে ১৮ আসন পেয়েছিল।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগ ও মামলা। সাধারণত ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত করতে মানুষ পুলিশ বা আদালতের কাছে যায় না। তাই বড় সংখ্যায় যখন ধর্ষণের অভিযোগ প্রকাশ হতে থাকে, তখন ধরে নিতে হবে সমাজের বিভিন্ন অংশের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ কমছে। অন্তত পাঁচটি ধর্ষণের মামলা গত এক মাসে ভালো রকম প্রচার পেয়েছে, এর কয়েকটির সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের নামও জড়িয়েছে। দুটি মামলা আদালত সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের জন্য তুলে দিয়েছেন। তৃণমূলের জন্য এটাও খারাপ খবর।
এর পাশাপাশি যেটা মমতার বরাবরের সমস্যা, সেটা হলো বেফাঁস মন্তব্য। চাপের মুখে তিনি অতীতেও বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, এবারও একটি ধর্ষণের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, ধর্ষণের শিকার নারী ‘অন্তঃসত্ত্বা ছিল’ বা ‘তাঁর অন্য কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল’ কি না, তা নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ, যাদের ভোট কম কিন্তু চিৎকার করার ক্ষমতা বেশি এবং সংখ্যালঘু সমাজের একটা অংশ তৃণমূলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। কিছুদিন আগে এক ছাত্রনেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা যথেষ্ট আলোড়িত হয়েছিল। গত নির্বাচনে কিন্তু প্রধানত তারাই তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে।
এরপরও এ মুহূর্তে বিধানসভা নির্বাচন হলে তাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তৃণমূল। আসন হয়তো কমবে। এর কারণ, গত নির্বাচনে বস্তুগত অবস্থা যা ছিল, এখনো তাই। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। নির্বাচনে এই ভোট তৃণমূলই পাবে। সিপিআইএম দলের পশ্চিমবঙ্গে উত্থান হলে এবং তারা বিজেপিকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আসতে পারলে, কিছুটা সমস্যায় পড়বে তৃণমূল। কারণ, সিপিআইএমকে এখনো মোটামুটি পছন্দই করে তারা। কিন্তু যতক্ষণ তারা দ্বিতীয় স্থানে আসার মতো অবস্থায় না পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণ মুসলমানরা তৃণমূলকেই ভোট দেবে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে কয়েকটি উপনির্বাচনে সিপিআইএমের ভোট সামান্য বেড়েছে। তবে আপাতত এটা মমতার জন্য সুবিধাজনক। কারণ, বাম ফ্রন্ট যদি বিজেপির ভোট কিছুটা টেনে নিজেদের ভোট বাড়াতে পারে, তবে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থা আরেকটু ভালো হয়। অর্থাৎ বাম ফ্রন্টের ভোট যদি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫-২০ শতাংশ হয়, আর বিজেপির ভোট ৩৮ থেকে ২৫-২৮ শতাংশে নেমে আসে, তবে আগামী এক দশক তৃণমূলের আর কোনো চিন্তাই থাকে না। তবে তৃণমূল দ্রুত ভেতর থেকে ভাঙছে। ব্যক্তিগত দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং দলের মধ্যে বিবাদ ক্রমে তাদের কমজোরি করছে।
তাদের প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি, যা শুধু ভারত কেন, নির্বাচনী রাজনীতির প্রশ্নে সম্ভবত গোটা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল দল। তাই তৃণমূলের এবং তাদের একমাত্র নেত্রীর ভেবে দেখা উচিত, অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই কীভাবে তাঁরা দলের ভাঙন রুখবেন। এ কঠিন কাজটি করতে না পারলে ২০২৪-এর নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ে মমতার মাথা তোলার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
● শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা