৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন ডাকা হয়েছে, সেখানে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী একটি বিরোধী দল এবং একজন বিরোধীদলীয় নেতা থাকলেও সংসদে যে কার্যত কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্বই নেই, সেটা সবার জানা। এর কারণ হচ্ছে, ৩০ ডিসেম্বরের একচেটিয়া নির্বাচন, যাকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন ‘তথাকথিত নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছেন আর বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বর্ণনায়, এই নির্বাচন হচ্ছে ‘ভুয়া নির্বাচন’।
নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই এই কারণে যে তা ঘটেছে প্রকাশ্যেই। যে কারণে নির্বাচনের ফলাফল দেখে প্রাথমিকভাবে এমনকি সরকারি দলের সমর্থকেরা পর্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। সবাই যখন একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচনের দাবি ও প্রত্যাশা করছিলেন, সেই সময়ে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যার ফলাফল সবাইকে বিস্মিত করেছে।
নির্বাচনের সময়ই কেবল যে দশম সংসদের সদস্যরা নিজ পদে বহাল থেকেছেন, তা নয়; ২০১৪ সালের মতোই ওই সংসদ বহাল রেখেই নতুন সাংসদেরা শপথ নিয়েছেন ২ জানুয়ারি। এমনকি ওই সদস্যরা পদে থেকেই ৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার শপথ নিয়েছেন। ফলে শুধু যে নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকল তা নয়, এরপরও সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের প্রতি একধরনের অবজ্ঞাও এখন দ্বিতীয়বারের মতো সবার সামনেই উপস্থিত থাকল। কিন্তু সংবিধানের এসব বিষয়ের বাইরেও এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার ফারাক যেভাবে অপসৃত হলো, তা ভবিষ্যতে অকস্মাৎ নাটকীয়ভাবে বদলে যাবে—এমন আশা করার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্র, সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের এই মেলবন্ধন সবার জন্যই ক্ষতিকর, তবে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন কিংবা এরপর বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচনের পরও প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের যতটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তার অবসানই এই নির্বাচনের লক্ষ্য ছিল কি না, আমরা জানি না, কিন্তু ফল যে তা–ই হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভবিষ্যতেও যে ‘এই ধরনের শৃঙ্খলা’ বহাল থাকবে, তা আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম ইতিমধ্যে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন (মানবজমিন, ৬ জানুয়ারি ২০১৯)।
নির্বাচনের ফলাফল কী ধরনের হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা দরকার, কিন্তু নির্বাচন কেবল ফলাফলের বিষয় নয়। এই ধরনের ‘নির্বাচন’, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ফলাফলের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্র এবং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখার জন্য বিবেচনা করা জরুরি, যেমন জরুরি আঞ্চলিক রাজনীতির জন্যও। বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এই বিষয়ের দিকে নজর না দিলেও, দেশের বাইরে বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণে এটাই মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই আলোচনা কেবল যে গত বছরগুলোতে বা নির্বাচনের আগে যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সমালোচনা করেছেন, তাঁরাই করছেন তা নয়, এমনকি যাঁরা আওয়ামী লীগের বিজয়কে অবধারিত বলে মনে করেছেন কিংবা আওয়ামী লীগ বিজয়ী হোক, সেটা প্রত্যাশা করেছেন, তাঁরাও এই প্রশ্ন তুলেছেন। এশিয়ান এজ পত্রিকায় প্রকাশিত ভারত ভূষণের ‘নো গেইন ফর ডেমোক্রেসি, অর ফর ইন্ডিয়াস ইন্টারেস্ট’, অর্গানাইজার ডট ওআরজিতে প্রকাশিত শ্রীরাধা দত্তের ‘ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি, লং টার্ম ইমপ্লিকেশন’ কিংবা ইন্ডিয়া টাইমস ডটকমে লেখা মিহির শর্মার ‘হোয়াই বাংলাদেশ, আ স্টার ইন দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড লুকস টারনিশড’ পড়লেই এই প্রশ্নগুলো দেখা যায়, অন্য আলোচনাগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম।
এসব প্রশ্নের একটা উত্তর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক প্রতিবেদনের মধ্যে আছে। এই সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদন এই নির্বাচনের আগের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। সেখানে অতীতের কয়েক বছরের মতোই বাংলাদেশকে হাইব্রিড রেজিম বা দো–আঁশলা ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দো–আঁশলা ব্যবস্থার একটা দিক হচ্ছে যে সেখানে অন্তত দৃশ্যমানভাবে নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল থাকে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সেই পরীক্ষায় উতরাবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কিছু দায় বিরোধীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গেছে, তাদের নির্বাচন বর্জনের কারণে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যাবে না। ২০১৪ সালের একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে ক্ষমতাসীনেরা আইনি বৈধতার সংকটে পড়েনি, কিন্তু তাদের যে নৈতিক বৈধতার সংকট ছিল, তা এখন কেবল বিরোধীদের অংশগ্রহণের কারণে দূর হয়নি। সেই কারণেই ক্ষমতাসীনদের জন্য এই ধরনের নির্বাচনের দরকার ছিল কি না, সেই প্রশ্ন তোলা যুক্তিযুক্ত (আনু মুহাম্মদ, জেতার জন্য এত কিছুর দরকার ছিল কি? প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি ২০১৯)।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে অগ্রসর হবে? ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কে আনিস আহমেদ নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নিউইয়র্ক টাইমস–এর আন্তর্জাতিক সংস্করণে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছিলেন, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের সামনে পছন্দ হচ্ছে ‘কর্তৃত্ববাদ বা উগ্রবাদ’ (কে আনিস আহমেদ, ‘বাংলাদেশ’স চয়েস: অথরিটারিয়ানিজম অর এক্সট্রমিজম’, নিউইয়র্ক টাইমস, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮)। কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোটাররা কর্তৃত্ববাদী শাসন পছন্দের সুযোগ পান, তার আদৌ কোনো উদাহরণ নেই, অন্তত আমার জানা নেই। তারপরও নিবন্ধকারের এই যুক্তি মেনে নিলে কর্তৃত্ববাদী পথেই বাংলাদেশের যাত্রা অব্যাহত থাকল। বিরোধীদের এখন কী করা উচিত, সেই বিষয়ে বলতে গেলে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেই বলতে হবে। অবশ্যই আমি সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত জাতীয় পার্টির ভূমিকার কথা বলছি না। জাতীয় পার্টিকে আমরা বড়জোর ‘অনিচ্ছুক সরকারি বিরোধী দল’ বলে বর্ণনা করতে পারি। কেননা, সংসদে বিরোধী দলের প্রয়োজন আছে বলেই তারা মনে করে না এবং তা তারা সুস্পষ্টভাবেই বলেছে (ডেইলি স্টার, ৪ জানুয়ারি ২০১৯)। ফলে জাতীয় পার্টি যে বিরোধী দলের ভূমিকা নেবে, তা মনে করা একধরনের বালখিল্য মাত্র।
বিরোধী দলের কী করা উচিত, এই নিয়ে গত কয়েক দিনের আলোচনা বারবার সীমিত হয়ে গেছে বিএনপির সাংসদদের আদৌ শপথ নেওয়া এবং সংসদে যাওয়া উচিত কি না, এই আলোচনার মধ্যে। সংসদে একচেটিয়া এক দলের আধিপত্য এবং একটি ‘অনিচ্ছুক সরকারি বিরোধী দল’-এর উপস্থিতিতে বিরোধী দলের সদস্যরা কী করতে পারেন, তার বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটজন সদস্যের সংসদে যাওয়া না–যাওয়ার প্রশ্নটি বিরাজমান রাজনীতিতে যথাযথ প্রশ্ন কি না, সেটাই আসলে বিবেচ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, সেখানে নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার রক্ষার প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে সংসদে যাওয়া না–যাওয়ার প্রশ্নকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্যে ক্ষমতাসীনদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে কেবল মেনে নেওয়াই হচ্ছে, তা নয়, তাকেই যথাযথ বলে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সংসদে অংশ নিলে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সদস্যরা অন্তত কথা বলতে পারবেন, কেননা গত পাঁচ বছরে সংসদের বাইরে থাকার কারণে তাঁরা কথা বলতে পারেননি, সমাবেশের সুযোগ পাননি। তার অর্থ কি এই যে সংসদের বাইরে কথা বলার জায়গাগুলো না থাকাই সঠিক? গত পাঁচ বছরে যে অবস্থা ছিল, তা–ই অব্যাহত থাকবে বা থাকা যুক্তিযুক্ত? অথবা যাদের সংসদে কোনো প্রতিনিধি নেই, তাদের সমাবেশের, মতপ্রকাশের অধিকার নেই? মনে রাখতে হবে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব দল হিসেবে বিএনপি বা জোট হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের একক বিষয় নয়। এসব কাঠামোর বাইরেও যাঁরা মনে করেন যে নাগরিকের সমাবেশের, মতপ্রকাশের, নিরাপদ জীবনের অধিকার সীমিত হয়ে এসেছে, তাঁদেরও ভাবতে হবে তাঁরা কী ভূমিকা নিতে চান। যাঁরা দেশে বিরোধীদের একটা ভূমিকা আশা করেন, কেননা বিরোধীদের ভূমিকা না থাকার অর্থ গণতন্ত্র না থাকা, তাঁদের বোঝা দরকার যে কেবল বিএনপির কাছে প্রত্যাশা করলে বা তাদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেই হবে না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর