বিভক্ত পশ্চিমা বিশ্বের সূর্য ডুবছে
জার্মানির মিউনিখে ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে পশ্চিমা বিশ্বের নেতাদের মধ্যে নজিরবিহীন মতবিরোধ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৩ সাল থেকে অনুষ্ঠিত এই নিরাপত্তা সম্মেলনটিকে আটলান্টিকের দুই তীরের পরাশক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এবারের সম্মেলনটি চিহ্নিত হবে ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের সূচনা হিসেবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব দিন দিন খর্ব হচ্ছে বলে যে কথা বলা হয়, তা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে একটা প্রকাশ্য বিতণ্ডা হয়ে গেছে মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলনে।
মিউনিখ সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সম্মেলনগুলোর একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন জেনারেল, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এই সম্মেলনে যোগ দেন। এবারের সম্মেলনের আলোচনার প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল দুটি: ১. পশ্চিমা দুনিয়ার ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব এবং ২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়া ও চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্রমবর্ধমান চেষ্টা।
সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ওয়াল্টার স্টাইনমায়ার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তো এখন ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বলে যে কিছু আছে, সে ধারণাটিকেই প্রত্যাখ্যান করছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার প্রতিবেশী ও মিত্রদের গ্রাহ্য না করেই তাদের মতো করে পথ চলছে।
জার্মান প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া পুরো বিশ্বকে বিপজ্জনক করে তুলছে। এই তিন শক্তি প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ব্যাপারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর কণ্ঠেও ছিল একই সুর। তিনি বলেন, ইউরোপকে তার নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই ঠিক করতে হবে। ইউরোপের প্রত্যাশা আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা হুবহু এক নয়। মাখোঁ স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘পশ্চিমা বিষয় দুর্বল হয়ে পড়ছে।’
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অবশ্য ইউরোপের অভিযোগকে সঠিক মনে করেননি। তিনি বলেছেন, আটলান্টিকের দুই তীরের মৈত্রী শেষ হয়ে গেছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত। তিনি বলেন, রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর শক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে তারা ইউরোপকে নিরাপদ রাখছে। ইউরোপের নেতাদের আশ্বস্ত করে পম্পেও আরও বলেন, ‘চীন কিংবা রাশিয়া নয়, বিশ্বে পশ্চিমারাই জিতছে। বেইজিং ও মস্কো যতই ‘সাম্রাজ্য গড়ার’ চিন্তা করুক না কেন, পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার করবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যতই আশার কথা শোনান না কেন, ইউরোপের নেতারা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না, সেটা আগেও কমবেশি শোনা গেছে। যেমন, ২০১৮ সালেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মার্কিন ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ইউরোপের নিজস্ব সেনাবাহিনীর কথা বলেছিলেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরতা কমানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে মাখোঁ তখন বলেছিলেন, ‘চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদের করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপের স্বয়ংক্রিয় কৌশলের দিকে যাওয়া উচিত। এ কৌশলের মধ্যে থাকতে পারে “ট্রু ইউরোপিয়ান আর্মি” তৈরি করা।’
শুধু যুদ্ধকৌশল কিংবা নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই নয়, পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার করবে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। পশ্চিমা মূল্যবোধ বলতে মূলত গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকেই বোঝানো হয়। বিগত বছরগুলোতে একাধিক জনমত জরিপে দেখা গেছে যে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়ছে।
যেমন, ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২৫ বছরের মধ্যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ব্যাপক মাত্রায় হারিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি মনোভাব জানতে ৪০ লাখের ওপর মানুষকে নিয়ে ৩ হাজার ৫০০টি জরিপ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। জরিপে গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তোষ সবচেয়ে বেশি ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এখন হতাশায় পড়েছে বলে জানিয়েছেন জরিপকারীরা। ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের অসন্তুষ্টি ৪৮ থেকে ৫৮ শতাংশ হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো প্রবল সংকট মোকাবিলা করছে। প্রতিনিয়তই যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে নাগরিক সুবিধা কমানো হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করছে। নিয়মিতই ইউরোপ-আমেরিকায় পেশাজীবী ও শ্রমিকেরা ধর্মঘটে যাচ্ছেন।
পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মিউনিখ সম্মেলনে পশ্চিমা নেতাদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব মূলত পশ্চিমা সভ্যতার পতনধ্বনিই শুনিয়ে গেল। বুঝিয়ে গেল, পশ্চিমা বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যেরও সূর্যাস্ত ঘনিয়ে আসছে।
বিশ্বসভ্যতার পরবর্তী সূর্য কোথায় উদিত হবে, সেটাও ক্রমেই স্পষ্ট হবে।
ওমর শরীফ: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
[email protected]