বিভক্ত ও দুর্বল ন্যাটো এখন পশ্চিমাদের নড়বড়ে ঢাল

কেন ন্যাটো জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না? প্রকৃতপক্ষে জোট হিসেবে ন্যাটোর মধ্যে উল্লেখ করার মতো অনৈক্য রয়েছেছবি : রয়টার্স

সাধারণত শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য ঢাল ব্যবহার করা হয়। কোনো কিছুর পেছনে লুকিয়ে সংঘাত এড়ানোর জন্যও ঢালকে ব্যবহার করেন কেউ কেউ। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিকেরা তাঁদের নানা মাত্রার ‘বীরত্ব’ প্রকাশ করতে গিয়ে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।

কিন্তু ঢালই যদি ভঙ্গুর হয় কিংবা যে উপকরণ দিয়ে ঢাল তৈরি হয়েছে, তাতে যদি ত্রুটি থাকে, তখন কী হয়? পশ্চিমা দেশগুলো সেটা কি বুঝতে পারছে? এ মাসে মাদ্রিদে হতে যাওয়া ন্যাটো সম্মেলনটি শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘পরিবর্তনমুখী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ৩০ দেশের এই জোট ‘মুক্ত বিশ্ব’ রক্ষায় কীভাবে একত্র হলো, তা নিয়ে সেখানে আত্ম-অভিনন্দনের বন্যাও বয়ে যেতে পারে। কিন্তু মূল প্রশ্নটাই এড়িয়ে যাওয়া হবে।

গত মার্চ মাসে পোল্যান্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ন্যাটোর কার্যত নেতা জো বাইডেন বক্তব্য দিতে গিয়ে জোটটির নেতারা কী ধরনের কথা বলবেন, আর কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, তার একটা মান ঠিক করে দিয়েছেন। বাইডেন তেজদীপ্ত শপথের সুরে বলেন, ‘ন্যাটোর প্রতি ইঞ্চি মাটি আমাদের সম্মিলিত শক্তির সবটা দিয়ে’ যুদ্ধের বাইরে রাখব। ওই বক্তব্যের কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো তৎপরতার ব্যাপারে উদাসীনতাই দেখা যাচ্ছে।

গত সপ্তাহে আইসল্যান্ডে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেল ওয়ালেশকে বাইডেনের সুরে সুর মেলাতে দেখা গেল। ইউক্রেনের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট লিথুওনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ায় হামলা করতে পারেন বলে চাউর হয়েছে। ওয়ালেশ সতর্ক করে বলেন, পুতিন এই দেশ তিনটিকে ইউক্রেনের মতো ‘প্রকৃত’ দেশ বলে মনে করেন না। কিন্তু বাইডেনের মতো ওয়ালেশও ইউক্রেন যাতে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা হাজির করেননি। যখন অনেক মিত্র দেশ সামনে এগিয়ে আসছে, তখন ইউরোপে ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা শীত নিন্দায় চলে যাচ্ছেন। তাঁরা ন্যাটো জোটকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করছেন। কিয়েভকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গেলে মস্কোকে ক্রুদ্ধ করা হবে—এমন যুক্তিতে তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো বল ছেড়ে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল শেষ বাঁশি বেজে গেছে। খেলা শেষ। কিন্তু খেলা শেষ হয়নি। এখন যেমন পুতিন তাঁর হাতের ঢাল পিটিয়ে পশ্চিমকে পরীক্ষার মুখে ফেলছেন। এখন ন্যাটো যদি নিজেকে না শোধরাতে পারে, তাহলে লুকানোর জায়গা তারা আর খুঁজে পাবে না। ন্যাটো কি আবার ব্যর্থ হবে?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত সার্বভৌমত্বের দিবাস্বপ্ন দেখা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের কাজগুলো দ্বিধাগ্রস্ততা ও ঢিলেমির ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত। আর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিকতর ওরবান যেন ক্রিজের অন্য প্রান্তে সপাটে ব্যাট চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার তুরস্কের সমস্যা সৃষ্টিকারী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজ উদ্যোগে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদের বিরুদ্ধে যেভাবে পেছন থেকে ছুরি মেরেছেন, সেটাও ন্যাটো জোটের অনৈক্যের বড় এক দৃষ্টান্ত।

ন্যাটোর গোবেচারা মহাসচিব স্টলটেনবার্গ সদস্যদেশগুলোর নানামুখী চাপ সামলাতে আর অনৈক্যের এই ফাটল মেরামত করতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম। পোল্যান্ড ও অন্য সম্মুখসারির দেশগুলো কঠোরতম পদক্ষেপ চায়। রাশিয়ার সীমান্তে অতিরিক্ত সেনার সঙ্গে স্থায়ীভাবে ভারী সমরাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের মোতায়েন চায় তারা। তাদের এ ধরনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘বলিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ইউক্রেনের নেতৃত্বের জন্য ন্যাটোর এই সম্মেলন হবে সবচেয়ে হতাশাজনক। ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার স্বপ্ন তাদের বিসর্জন দিতে হচ্ছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা ন্যাটোর নেতাদের উদ্দেশে কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, ‘অবশ্যই আমরা তাঁদের মুখ থেকে সমর্থন শব্দটা শুনতে পাই...সে কারণে আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ ন্যাটোর সম্মেলন শেষ হওয়ার পর তিনি আর জোটটির নেতাদের ‘কিছুই না করার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারবেন না। কেননা, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে কিংবা ‘কৃষ্ণসাগরের নিরাপত্তা’ নিয়ে যে ‘বাস্তব’ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তা হয়তো স্বপ্নেও তিনি ভাবতে পারবেন না! কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরে রাশিয়া অবরোধ করে রেখেছে, যা বিশ্বে খাদ্যসংকট সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারা ক্ষমার অযোগ্য একটা বিষয়।

কেন ন্যাটো জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না? প্রকৃতপক্ষে জোট হিসেবে ন্যাটোর মধ্যে উল্লেখ করার মতো অনৈক্য রয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে যতটা শক্তিশালী ও গোছালো বলে মনে হয়, বাস্তবে জোটটি তেমন নয়। ইউক্রেন হাত বাড়ানো দূরত্বে থাকায় ন্যাটোকে তা-ও কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখছি। গত বছর আফগানিস্তানে ন্যাটো পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়েছিল। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন আরও মরিয়া হয়ে ওঠে, যদি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো কানাগলিতে ঢুকে পড়ে, তাহলে ন্যাটোর দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতা আরও বেশি অনিবার্য হয়ে উঠবে। সোভিয়েত পরবর্তীকালে ন্যাটো জোটের যে ধাপ্পাবাজি, সেটি সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

এত বড় কোনো সংস্থায় সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতৈক্য থাকবে, সে ধরনের কিছু আশা করা বোকামি হবে। কিন্তু সামরিক সক্ষমতার প্রসঙ্গ যখন উঠছে, তখন সবগুলো সদস্যদেশের মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কে কার পেছনে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা যেন সবার মাঝে। রাশিয়ার দিক থেকে আসা পারমাণবিক ও রাসায়নিক যুদ্ধের প্রচ্ছন্ন হুমকিতেই ন্যাটোর দেশগুলোর কণ্ঠ যেন বিকল হয়ে গেছে। আবার ন্যাটোর জোটের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া কোনো কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

সাংগঠনিক ও সামরিক, দুটি ক্ষেত্রেই ন্যাটোর কার্যক্রম সবখানেই রয়েছে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্র—এই তিন দেশে জোটটির যৌথ কমান্ডের সদর দপ্তর অবস্থিত। আবার এর শীর্ষ জেনারেল বেলজিয়ামে থাকেন। এ রকম বাস্তবতায় অস্ত্র সরবরাহব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণে যেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে, ঠিক তেমনি গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানেও বাধা তৈরি হচ্ছে। আবার ইউরো-আটলান্টিকে রাশিয়াকে এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে সামলাতে গিয়ে ন্যাটোকে অনেক বেশি চাপ নিতে হচ্ছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো বল ছেড়ে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল শেষ বাঁশি বেজে গেছে। খেলা শেষ। কিন্তু খেলা শেষ হয়নি। এখন যেমন পুতিন তাঁর হাতের ঢাল পিটিয়ে পশ্চিমকে পরীক্ষার মুখে ফেলছেন। এখন ন্যাটো যদি নিজেকে না শোধরাতে পারে, তাহলে লুকানোর জায়গা তারা আর খুঁজে পাবে না। ন্যাটো কি আবার ব্যর্থ হবে?

সাইমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ানের লেখক ও পররাষ্ট্রবিষয়ক পর্যবেক্ষক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে