দেশে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি হলে বা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পেলে জনসাধারণ গ্যাস-সংকটে পড়ে। আর ২০২২ সালের প্রথমার্ধে এ দুটি কারণই সাধারণ জনগণের দ্বারে এসে কড়া নাড়ে। পয়লা রমজানে দেশের গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি ও তা থেকে সৃষ্ট গ্যাস-সংকট বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস ব্যবস্থাপনার নাজুক অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। ওই দিন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে ছয়টি কূপ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দেশে গ্যাস সরবরাহ দৈনিক ৪০ কোটি ঘনফুট কমে যায়। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে গৃহস্থালি, শিল্প, পরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে।
পয়লা রমজানের আগের দিন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে কূপে গ্যাসের সঙ্গে বালু চলে আসা লক্ষ করা হয়। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন অয়েল কোম্পানি বালুপ্রবাহকবলিত কূপটিকে শনাক্তকরণের কাজ সম্পন্ন করার সঙ্গে বন্ধ করা কূপগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করলে গ্যাসপ্রবাহ আবার বাড়ে। যদিও কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে গ্যাসকূপে বালুর সমস্যাটি পুরোপুরিভাবে সমাধান করতে তিন-চার দিন সময় লাগবে।
বিবিয়ানা এককভাবে দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্র। দেশের অন্যান্য সব গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনহার ক্রমাগতভাবে নিম্নমুখী, তবে বিবিয়ানায় সে প্রবণতা এখনো দেখা দেয়নি। দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে, তার মধ্যে ১৬টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ১৫ শতাংশ গ্যাস। বাকি চারটি থেকে মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ গ্যাস এসে থাকে। আর এর মধ্যে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের অবস্থান শীর্ষে এবং এই একটি গ্যাসক্ষেত্র থেকেই দেশের মোট দৈনিক উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ গ্যাস উৎপাদিত হয়। তাই এটির গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হলে তা বড় আকারের সংকট হিসেবে দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো গ্যাসকূপে গ্যাসের সঙ্গে বালু এল কেন। গ্যাসকূপে বালুপ্রবাহ কেবল কূপটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বরং এই বালু গ্যাস প্রসেসে প্ল্যান্টে পৌঁছালে গ্যাস সরবরাহে আরও ব্যাপক আকারে বিপত্তি ঘটতে পারে। গ্যাস উৎপাদন কর্মে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করেন, কোনো গ্যাস রিজার্ভার থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত হারে গ্যাস উত্তোলন করা হলে কোনো এক পর্যায়ে গ্যাসের সঙ্গে বালু প্রবাহিত হতে পারে। এতে গ্যাস রিজার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। প্রশ্নটি হচ্ছে তাহলে কি বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস তোলা হচ্ছে? এর জবাবে শেভরন কোম্পানির কারিগরি কর্মকর্তার সূত্র বলেছে, শেভরন কোম্পানি বিবিয়ানাতে অতিরিক্ত উৎপাদন করে না বরং তারা গ্যাস উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর রিজার্ভার ম্যানেজমেন্ট করে থাকে, যাতে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেওয়া দেশের সব গ্যাসক্ষেত্রের দৈনিক উৎপাদন হার ও তথ্যাদি অনুযায়ী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ১২০ কোটি ঘনফুট। আর বিবিয়ানায় দৈনিক গ্যাস উৎপাদন হয় ১২৫ থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, সেখানে অতিরিক্ত গ্যাস তোলা হচ্ছে। এ বিষয়টির ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেভরন কোম্পানির সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনক্ষমতা দৈনিক ১৩০ কোটি ঘনফুট। এ বিষয়টি নাকি শেভরন একাধিকবার পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছে এবং ওয়েবসাইটে তা সংশোধন করার অনুরোধ করেছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা যেহেতু তথ্য সংশোধন করেনি, তাই এটা নিশ্চিত হওয়া জরুরি যে বিবিয়ানা উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে কি তারা শেভরনের সঙ্গে একমত নয়? যদি তা হয়, তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা শেভরনকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে পারে।
২০১২ এবং ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সে দেশ দুটি তাদের সমুদ্রসীমানায় যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রচুর গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার করে। অথচ আমরা আমাদের কার্যক্রমকে কেবল সমুদ্র বিজয়ের উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি।
গ্যাসকূপে বালুপ্রবাহ ঘটার কারণ যা-ই হোক না কেন, তা খুঁজে বের করে তার একটি কারিগরি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কিন্তু শেভরন বা পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে তা দেওয়া হয়নি। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এবং দেশের গ্যাসসম্পদের ভোক্তা হিসেবে বিষয়টি জানার অধিকার আমাদের সবার রয়েছে। গ্যাসকূপে বালুপ্রবাহের কারণে কূপ বিনষ্ট হওয়ার ঘটনা অতীতে ঘটেছে। ফলে বিষয়টি আমাদের শঙ্কিত করে বৈকি।
বিবিয়ানা গ্যাসকূপের সমস্যাকে আমাদের জন্য একটি ঘুম ভাঙানোর ডাক হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে মোট ২৬টি উৎপাদন কূপ রয়েছে। কেবল ৬টি কূপ সাময়িকভাবে বন্ধ করার কারণে দেশে গ্যাস-সংকটের পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে দাঁড়াল, সেখানে যদি ১০টি কূপ বন্ধ হয় কিংবা যদি গ্যাসক্ষেত্রটি বর্তমানের শীর্ষ উৎপাদন অবস্থান থেকে দ্রুত নিচে নেমে যেতে থাকে, তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আর বাস্তবতা হলো গ্যাসবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি অদূর ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে অথবা হঠাৎ করেই তার উৎপাদন শক্তি হারিয়ে আরও দুর্বল হয়ে একসময় নিঃশেষিত হবে।
গ্যাস সরবরাহের উৎস হিসেবে এ মুহূর্তে বিবিয়ানার কোনো বিকল্প গ্যাসক্ষেত্র নেই। কারণ, এর জন্য প্রয়োজনীয় জোরালো অনুসন্ধানকাজ করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের মতো এ রকম বদ্বীপ অঞ্চলগুলো পৃথিবীর সব স্থানেই প্রচুর তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সে দেশ দুটি তাদের সমুদ্রসীমানায় যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রচুর গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার করে। অথচ আমরা আমাদের কার্যক্রমকে কেবল সমুদ্র বিজয়ের উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। গত ২০ বছরের গ্যাস অনুসন্ধানের দুর্বল ধারাকে বদলে দিয়ে একটি জোরালো অনুসন্ধানকাজ শুরু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জ্বালানি নিরাপত্তার পথে শেষ ট্রেনটি ধরতে পারে। অন্যথায় পুরোপুরিভাবে অসম্ভব ব্যয়বহুল আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হবে। এ ধরনের একটি পথ ধরে অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
● ড. বদরূল ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক