বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদই সংকটের কারণ
>দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বার্ষিকী আজ। এই প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে। কাজেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও বাসনা বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন অন্যতম। স্বাধীনতার ঘোষণায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু ৪৫ বছরেও গণতন্ত্র সুসংহত হয়নি, সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং বৈষম্য তীব্রতর হয়েছে; মানবিক মর্যাদাও ভূলুণ্ঠিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকবে, অথচ কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না—এটি ভাবা যায় না।
জনপ্রতিনিধিত্ব গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক শর্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সংগ্রামে উচ্চারিত হয়েছিল ‘নো রিপ্রেজেন্টেশন নো ট্যাক্সেশন’ অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর দেওয়া হবে না। আমাদের আরও দুর্ভাগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করার সমস্যা ৪৫ বছরেও ফয়সালা হয়নি। ১৯৯৫-৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধান সংযোজিত করে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেয়। এরপর ’৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার পেছনে দলমত-নির্বিশেষে জনসম্মতি ছিল।
২০০৮ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই নির্বাচনটিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ তার ধ্যানধারণা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দেয়। তবে এই সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি যে প্রস্তাব করেছিল, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। উচ্চ আদালতের একটি রায়কে ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এটা জনগণের প্রত্যাশিত ছিল না। ২০০১–০৬–এর বিএনপি সরকারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। এই সুযোগেই ২০০৭-এর জানুয়ারিতে সামরিক বাহিনী সমর্থিত অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের বুকে চেপে বসে। এর ফলে বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই কমবেশি নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে কেবল বিএনপিই নয়, অন্য অনেক দলও নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচনবিরোধী এই আন্দোলনে সহিংসতারও কমতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়ে যেতে পারল। এর ফলে ১৫৪ জন জাতীয় সংসদের সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়ে গেল, যা একটি সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট। এখান থেকেই সাম্প্রতিক কালের গণতন্ত্রের সংকটের উৎপত্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় শেষ মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু সেই টেলিফোন সংলাপ আরও উত্তাপ সৃষ্টি করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন, প্রয়োজনে আরেকটি নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন আর হয়নি। না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৫ সালে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এর জন্য এক দল অন্য দলকে দোষ দিয়েছে এবং দোষ দিয়ে যাচ্ছে। এ আন্দোলনে অশুভ শক্তির অনুপ্রবেশের ফলে যদি দুঃখজনক সহিংসতা ঘটে থাকে, তাতে বিএনপি সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করতে পারত। তা না করায় সরকার বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানোর মওকা পেয়ে যায়। এর ফলে দল হিসেবে বিএনপি যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়েছে।
সে সময়ের তুলনায় দেশে এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করলেও বিএনপিকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। রাজনীতি এখন অনুমতির রাজনীতি। গণতন্ত্র এখন অনুমতির গণতন্ত্র। দেশের সাধারণ নাগরিকেরা এ ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যাশা করিনি। জনগণ চায় দেশের সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক একটি সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সূচনা করেছেন। স্বাভাবিকভাবে আমরা এই সংলাপ থেকে শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের পথ তৈরি হবে বলে আশা করতে পারি। ক্ষমতাসীন দলকে মনে রাখতে হবে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বিরোধী পক্ষের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটাই নিয়ম, এটাই রীতি। বিরোধী দল বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকলে সেটা শাসক দলের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে না। স্বাধীনতার ৪৫ বছর সরকার ও বিরোধী দল কঠিন রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সংলাপের টেবিল বেছে না নিয়ে যে সংঘাতের পথে যায়; এটা সাধারণ নাগরিকদের হতাশ করছে। এবং রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন হতে বাধ্য করছে। এর ফলে বিরাজনীতিকীকরণের সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। স্বাধীন দেশে এমন সাংঘর্ষিক রাজনীতি আমাদের কারোরই প্রত্যাশিত নয়। আশা করব সব পক্ষের লোকেরই সুমতি ফিরে আসবে। এবং সবাই আলাপ-আলোচনা করে জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলো কীভাবে দ্রুত সমাধান করা যায় সে ব্যাপারে আন্তরিক হবে। চাই সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। চাই সবাই বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণের পথ বেছে নেবে।
বেগম খালেদা জিয়া গত বছরের মার্চ মাসে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে যে ভিশন বা ভাবকল্প তুলে ধরেছিলেন, তার মধ্যে ছিল একটি রেইনবো নেশন বা রংধনু জাতি গঠন, এক দিনের নির্বাচনী গণতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, স্থানীয় সরকারগুলোকে সঠিকভাবে ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের হাতে স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব তুলে দেওয়া। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় আয় মাথাপিছু পাঁচ হাজার ডলার অর্জন করা প্রভৃতি। এসব লক্ষ্য নিয়ে দ্বিমতের খুব সুযোগ নেই। আশা করি এমন এক শুভদিন আসবে, যখন আমরা সম্মিলিতভাবে এসব লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাব।
মাহবুব উল্লাহ: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।