বিদেশে বিনিয়োগ পুঁজি পাচারকে আড়াল করবে

এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশে পুঁজি পাচার। যদিও এ সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, তবু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর যা হওয়ার কথা, তার চেয়ে এক শতাংশ বা দেড় শতাংশ কম হচ্ছে পুঁজি পাচার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায়। এই ক্রমবর্ধমান পুঁজি পাচারের কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ২৩ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অপর দিকে সরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত গত এক দশকে বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তেমন কমছে না। এই পুঁজি পাচারকারীরা জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। তারা যদি ব্যাপকহারে বিদেশে পুঁজি পাচার না করত, তাহলে এত দিনে বাংলাদেশ শুধু ভারত নয়, শ্রীলঙ্কাকেও পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির বিচারে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশে পরিণত হতো। সে জন্যই, শুধু সরকার নয়, দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশির কর্তব্য এদের ঘৃণা, বর্জন এবং প্রতিহত করা।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলাকে উপনিবেশ করার আগে কয়েক শ বছর ধরে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচুর্যময় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত ছিল তদানীন্তন বাংলা। এই স্বীকৃতি প্রথম দিয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, যিনি বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের আমলে এ দেশে এসেছিলেন। দ্বিতীয় স্বীকৃতিটি এসেছিল মোগল শাসক আকবরের ‘নবরত্ন’ সভার খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের লিখিত ইতিহাসে। তাঁর রচিত আকবরনামায় তিনি স্বীকার করেছেন, আকবরের শাসনাধীন ভারতবর্ষে সবচেয়ে প্রাচুর্যময় প্রদেশ ছিল ‘সুবা বাংলা’। তৃতীয় যে স্বীকৃতি, সেটা দিয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরাসি ‘কোর্ট ডাক্তার’ ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার। বার্নিয়ারের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচুর্যময় অঞ্চল হিসেবে মিসরের যে সুনাম ছিল, সে সুনামের প্রকৃত দাবিদার ছিল বাংলা। কিছুদিনের মধ্যেই আরেকজন ফরাসি ব্যবসায়ী ট্যাভারনিয়ার বার্নিয়ারকে এ বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ট্যাভারনিয়ার চামড়ার ব্যবসার জন্য বেশ কয়েকবার বাংলায় আসার কারণে এই অঞ্চল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কার্ল মার্ক্স বার্নিয়ারের এই স্বীকৃতির উদ্ধৃতি দেওয়ায় বিশ্বে তা বহুল পরিচিতি অর্জন করেছে।

১৭৫৭ সালে বাংলা দখল করার পর ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী-সিপাহসালার এবং সিপাহিরা জাহাজের পর জাহাজ বোঝাই করে বাংলা থেকে ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে ইংল্যান্ডে নিয়ে গেছে। তাদের এই পুঁজি পাচারের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে লন্ডন বন্দরে লুণ্ঠিত সামগ্রীবাহী জাহাজগুলো খালাস করার জন্য তিন মাসের একটি জাহাজ-জট সৃষ্টি হয়েছিল বলে প্রমাণ করেছেন ব্রুক এডামস নামের একজন মার্কিন ইতিহাসবিদ। আরও অনেক ঐতিহাসিকের গবেষণার মাধ্যমে এই বাংলা লুণ্ঠনের কাহিনি প্রমাণিত হওয়ার ফলে এখন ইতিহাসে এই লুণ্ঠন পর্বকে ‘দ্য বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার নামে আবার ২৪ বছরের জন্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হওয়ায় আরেক দফা লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও পুঁজি পাচারের শিকার হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান। সে জন্যই স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের কল্যাণে বাংলাদেশের কপালে তকমা জুটেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ এবং ‘বটমলেস ব্রেড বাস্কেট’। এই দুটি ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন পর্বের ২১৪ বছর পার হয়ে এসে ভারতবর্ষের ‘একদা সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ’ বাংলার কপালে কেন এই অপমানতিলক জুটল, সেটা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে কেন বর্তমান সময়ের পুঁজি পাচারকারীদের আমি ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ বলছি।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আগাগোড়াই প্রধান বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর শাসনামল থেকে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন বাড়তে শুরু করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি স্বৈরাচার এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩১ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার হয়েছে।

প্রবাসী আয়ও বঙ্গবন্ধুর আমলে অর্থনীতির জন্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৩ সালের প্রথম বৈশ্বিক তেলসংকটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোতে যখন নগর উন্নয়নযজ্ঞ শুরু হয়, সেখানে সস্তা শ্রমিক জোগানের অন্যতম আকর্ষণীয় সূত্র হিসেবে সত্তর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক অভিবাসনে গতি সঞ্চারিত হয়। গত সাড়ে চার দশক অভিবাসনের এই ধারা বেগবান রয়েছে। নব্বই দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশিদের অভিবাসন দ্রুত বাড়তে শুরু করে, যার ফলে গত ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা বাংলাদেশিদের গন্তব্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালের শেষে সারা বিশ্বে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। যদিও অবৈধ অভিবাসনের কারণে এ ক্ষেত্রে একটা ‘গ্রে জোন’ রয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আগাগোড়াই প্রধান বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনো ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর শাসনামল থেকে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন বাড়তে শুরু করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি স্বৈরাচার এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩১ বছর একই প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার হয়েছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রবাসী আয় দ্রুত বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তখন এরশাদ সরকারের আমদানি উদারীকরণ নীতিমালা ভারতের তুলনায় প্রায় ছয় বছর আগে বাস্তবায়িত হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে চোরাচালান গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়, যার ফলে চোরাচালানের অন্যতম সুবিধাজনক পেমেন্ট সিস্টেম হিসেবে ‘হুন্ডি সিস্টেম’ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এরপর থেকে বিদেশে বাংলাদেশিদের অভিবাসনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশে পুঁজি পাচারও ক্রমশ বেড়ে এখন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালে ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী বৈধ পথে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যার বিপরীতে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির প্রাক্কলন মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ২০১৮ সালেই পুঁজি পাচারও প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

এ পর্যায়ে বলা প্রয়োজন, বৈধ পথে হোক কিংবা হুন্ডি সিস্টেমে হোক, যেভাবেই দেশে প্রবাসী আয় আসুক, এই টাকার সিংহভাগ প্রধানত নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকগুলোতে আমানত হিসেবে জমা পড়বেই। সে জন্যই আমরা দেখছি, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে এখন ৬১ হলেও ব্যাংকগুলোতে আমানতের ঢল অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব অনুয়ায়ী, ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার আমানত রয়েছে, অথচ খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণও হয়তো এখন ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। এর ফলে ‘উদ্বৃত্ত আমানত’ এ দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেটা বিদেশে পাচার করার যে সনাতন সংস্কৃতি আমদানি বাণিজ্যের ‘ওভার ইনভয়েসিং’ এবং রপ্তানি বাণিজ্যের ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ পদ্ধতির প্রায় একচেটিয়া দখলে ছিল, তার সঙ্গে জোরেশোরে যুক্ত হলো দুর্নীতিবাজ সামরিক-সিভিল আমলা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং নব্য ব্যাংক-মালিকদের পুঁজি পাচারের মহাযজ্ঞ।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিককালে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানোর জটিল পদ্ধতি অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিপ্লবের কারণে প্রবাসী আয় পাঠানোর হুন্ডি সিস্টেমও একেবারেই সহজ ও উন্নত হয়ে গেছে। উপরন্তু, এই চার দশকে পুঁজি পাচারের প্রয়োজনে হুন্ডি ডলারের একটা বিশাল চাহিদাকাঠামো সম্প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, এতে নাকি বিদেশে পুঁজি পাচার কমবে। আসলে পুঁজি পাচারকে আড়াল করবে এই সিদ্ধান্ত। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২৩ শতাংশে স্থবির রয়েছে। এই হারকে বাড়ানোই অর্থমন্ত্রীর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বিদেশে বিনিয়োগ উৎসাহিত করলে এই স্থবিরতা কাটবে না।

ড. মইনুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি