২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিদায়ী গভর্নরের মনোবেদনা ও ব্যাংকিং খাতের নেতৃত্ব

ফজলে কবির

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বিদায়বেলায় কিছু কথা বলে গেলেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর যেন অন্তরের দাগ মনে এল। এটি নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের জন্য একটি সতর্কবার্তাও বটে। দুজনেই পদস্থ আমলা—অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব। দুজনেরই পথ এক। তবে মত বা দৃষ্টিভঙ্গি এক কি না, এখনো বলা যাচ্ছে না। না হলেই ভালো। অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিক অনুষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আবদুর রউফ তালুকদারকে যতটুকু চিনেছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে মূল্য দিতে জানেন। সর্বদা স্বাধীন মত প্রকাশে উচ্চবাক থাকতেন, যে গুণ তিনি ধরে রাখতে পারলে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নয়, জাতিরও কল্যাণ করতে পারবেন।
সাংবাদিকেরা ফজলে কবিরের গত ছয় বছরের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বিদায়ী গভর্নর জানালেন, পদটি তিনি উপভোগ করেননি। ধন্যবাদ তাঁর সদোক্তির জন্য।

উপভোগ না করারই কথা। একজন মন্ত্রীর অধীন অর্থসচিব হওয়া আর দেশের সার্বিক অর্থব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়িত্বে গভর্নর হওয়া এক কথা নয়। নদী থেকে সমুদ্রে পড়ার মতো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় কাজ বাজেট, যা জিডিপির ১৫ ভাগ। আর ব্যাংকনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিঋণ জিডিপির ৪০ ভাগের বেশি, জাতীয় মুদ্রায়ণ ৫০ ভাগের বেশি। ওদিকে বাজেট ঘাটতির ৪৪ ভাগ জুগিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অঙ্ক বাদেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুণগত দায়িত্ব বিশাল। তা হলো জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ও নিয়োগ যথাসম্ভব সর্বোচ্চ করার দায়িত্ব। এটি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ২ থেকে ৪ ভাগের মধ্যে সহনীয় বা আরামদায়ক পর্যায়ে রাখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং শাস্ত্রের ভাষায় এর নাম ‘ডুয়েল ম্যান্ডেট’ বা অধিকারসংবলিত দ্বৈত দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে এ জন্য প্রেসিডেন্টের পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭-০৯ সালের বড় মন্দা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য যোগ্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন সে দেশের ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ার বেন বারনানকে। তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ বানায়। বলা হয়, তিনি দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা থেকে উদ্ধার করে প্রবৃদ্ধির পথে স্থাপন করেছিলেন।

বিদায়ী গভর্নর দাবি করে গেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে, এটা অসম্ভব। যদি তা–ই হয়, তাহলে তিনি কেন সচিবালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন তুলে দেওয়ার দাবি করতে পারলেন না? ও রকম নিয়ন্ত্রণ কোনো উন্নত দেশে থাকে না। ওটা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অবশিষ্ট। ব্রিটেনেও এখন আর ও রকম নেই। শোনা যায়, সচিবালয়ে নাকি ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক উইং’ নামে একধরনের ‘রিমোট কন্ট্রোল’ চালু হয়েছে।

গভর্নর হওয়ার যোগ্যতা কী হওয়া উচিত—এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, ‘গভর্নর পদে পুরোপুরি অর্থনীতিবিদ না হলেও চলবে।’ অর্থাৎ আধাআধি অর্থনীতিবিদ হওয়াই নিরাপদ। কারণ, পুরোপুরি অর্থনীতিবিদ হলে তিনি বিদ্যায় ভর করে সুদনীতি, বিনিময়ের হার ও ঋণখেলাপির মাত্রা ঠিক করবেন। প্রভাবশালী মহল বা সচিবালয়ের দিকে মুখ চেয়ে বসে থাকবেন না। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিক রঘুরাম রাজন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হয়ে ব্যাংকিংবিদ্যাকেই সমৃদ্ধ করেছেন। তেমনি করেছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত অর্থনীতিক উরজিৎ প্যাটেল। তাঁরা কেউই বিদ্যালব্ধ নীতির প্রশ্নে আপস করে পদ আঁকড়ে ধরে বসে থাকেননি।

আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্যে অর্থনীতিবিদের অভাব নেই। তারপরও তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালানোর জন্য কানাডা থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হলো অক্সফোর্ড–প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ মার্ক কারনিকে। তিনি ব্রিটিশ নাগরিকও নন। তাতে কী। এসব কাজের জন্য চাই প্রজ্ঞা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা। শুধু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আর আনুগত্য নয়; গভর্নরের কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির একটা সনদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে, সচিবালয়, আইন ও নীতি প্রণয়নে অভিজ্ঞ আমলারাই এই পদে ভালো করছেন।’ এই ‘ভালো’ মাপার মাপকাঠি তিনি কোথায় পেলেন বোঝা গেল না।

নানান ভয়ে মিডিয়ার মুখোমুখি না হয়ে চুপচাপ পদে বসে দিন পার করা মানে ভালো কাজ নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপে বড় লুটেরাকে বড় ছাড় দেওয়া ভালো কাজ নয়। বারবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলিয়ে এতে মাধুর্যমণ্ডিত করা নীতিশাস্ত্রের শুভ কাজ নয়। ৬৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে ৬ বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে দেওয়া দক্ষ প্রশাসকের লক্ষণ নয়। হোটেলে বসে ব্যবসায়ীদের চাপে রিজার্ভ হার কমানোর ওয়াদা করে আসা দৃঢ়তার কাজ নয়। একটা ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৯০ ভাগ খেলাপি হয়ে গেল তা দেখতে না পাওয়া ভালো নিরীক্ষার নজির নয়। মাঝেমধ্যেই হাইকোর্ট থেকে শুধরে নেওয়ার নোটিশ পাওয়া ভালো নেতৃত্বের উদাহরণ নয়।

আরও বলা যায়, বেঠিক বিনিময়ের হারের জন্য ডলার–সংকট সৃষ্টি করা গবেষণার প্রতি ভালো রুচির লক্ষণ নয়। নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বিনিময়ের হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া মাঠপর্যায়ের জ্ঞান প্রমাণ করে না। একদিকে আর্থিক ডিরেগুলেশনের কথা বলে সুদহারের ওপর আরোপিত টুপি অকাতরে মেনে নেওয়া ভালো তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিচয় নয়। কোনো সুস্থ অর্থনীতিবিদ সঞ্চয়পত্রের অবাজারীয় উচ্চ সুদহার মেনে নিতে পারেন না। গভর্নরের আশপাশের উপদেষ্টা ব্যাংকের পুরোনো চাকরিজীবী বলে তাঁরা পদে পদে রক্ষণশীল হবেন—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গভর্নর হবেন তত্ত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ আত্মবিশ্বাসী। তিনি আর্থিক খাতের ট্রাবলশুটার নন, উদ্ভাবনী চিন্তায় ফাইন্যান্সিয়াল ইনোভেটর।

কি জ্ঞান, কি উদ্ভাবন, কি গবেষণা—আমাদের সব প্রতিষ্ঠানেই এগুলোর রাষ্ট্রীয় কদর নেই বা থাকলেও তা কিঞ্চিৎ, তা পরিকল্পিতভাবেই অবজ্ঞার শিকার। তাই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবন—এ দুই সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এগুলো করা লোকেরা নাকি একটু স্বাধীনচেতা হয়। মেধা আর অকাতর আনুগত্য এক পথে যায় না। তারপরও অনেক উন্নয়নশীল দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হয়। ভারতে রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সে দেশের অর্থমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব সবারই জানা ছিল। গভর্নর পদের নবায়ন পাননি, কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ করেছেন মর্যাদার সঙ্গে। শিকাগোতে ফিরে যাওয়ার বেলায় বলে গেছেন যে তিনি চাকরিকালীন প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছেন। আমাদের বিদায়ী গভর্নরের অনুভূতি ঠিক তার উল্টো।

আরও পড়ুন

বিদায়ী গভর্নর দাবি করে গেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে, এটা অসম্ভব। যদি তা–ই হয়, তাহলে তিনি কেন সচিবালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন তুলে দেওয়ার দাবি করতে পারলেন না? ও রকম নিয়ন্ত্রণ কোনো উন্নত দেশে থাকে না। ওটা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অবশিষ্ট। ব্রিটেনেও এখন আর ও রকম নেই। শোনা যায়, সচিবালয়ে নাকি ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক উইং’ নামে একধরনের ‘রিমোট কন্ট্রোল’ চালু হয়েছে। ওরা নাকি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য ও কাজের মূল্যায়ন করবে। এসব তৎপরতা ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ও সংশোধনী ২০০৩’-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় বাতিলযোগ্য।

বিদায়ী গভর্নর তাঁর সহকর্মীদের অমর্যাদা ও ক্ষোভের বিহিত করে গেলেন না। কারণ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ববাদ তাঁর কাছে অসুবিধার মনে হয়নি। ওতে তিনি অভ্যস্ত। সচিবালয়ের এই কর্তৃত্ব এতটাই সর্বব্যাপ্ত যে মুদ্রানীতির ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই। তাঁরা জানেন, হাত-পা বাঁধা কবি কী গান গাইতে পারবেন। মাঝেমধ্যে বাজেটে আসন্ন মুদ্রানীতির প্রায় সবটাই বলে ফেলা হয়। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কত কথা বলা হলো। কিন্তু এটা যে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ, তার স্বীকৃতি নেই। গুরুত্বহীনতার কারণে এটি এখন ষাণ্মাসিক থেকে বার্ষিক দলিলে পরিণত হয়েছে। নাড়ির স্পন্দনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। অথচ মুদ্রানীতি ভারতে হয় কমপক্ষে চারবার, আমেরিকায় আটবার। প্রতিবার এগুলো মিডিয়া ও সরকারের চূড়ান্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে।

আরও পড়ুন

ভারতের সাবেক গভর্নর ডি সুব্বারাও একবার অতিথি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছিলেন। তিনিও আমলা থেকে গভর্নর হয়েছিলেন। এর আগে তিনি আমেরিকার ওহাইও স্টেট ও এমআইটিতে পড়েন। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেটও করেছেন। বইও লিখেছেন। সে সভায় গভর্নর কবির সভাপতিত্ব করছিলেন। গভর্নর সুব্বারাও বললেন যে তিনি প্রথম কর্মজীবনে আমলা হলেও যেদিন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছেন, ঠিক সেদিন থেকে আপন প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ব্যাংকে গবেষণা ও জ্ঞানের মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করেছেন। কারণ, তাঁর মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোপরি একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর রউফ তালুকদার শ্রী সুব্বারাওর এই দিকনির্দেশনায় প্রাণিত হয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানকেও একটি জ্ঞানভিত্তিক নীতি কেন্দ্রে পরিণত করবেন—এটা আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধতর। তিনিও উপভোগ করতে পারবেন প্রতিটি দিন।

ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।