১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা যেখানে ছিলাম, তা থেকে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বরে অনেক এগিয়েছি। বিশ্বব্যাংক ও তার অনুসারীদের উন্নয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে এখন গর্ব করা যায়। মাথাপিছু গড় আয়, মোট জাতীয় আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলেছে। উৎপাদন বাড়ছে, আরও কিছু সূত্র থেকে রাষ্ট্রের আয় হচ্ছে। রাস্তাঘাট, দালান-কোঠা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ অনেক বেড়েছে।
১৯৭১-এ কোথায় ছিলাম আর আজ আমরা কোথায় আছি, এ প্রশ্নে উন্নয়নের হিসাব নিতে গেলে কিছুটা বিস্মিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো, উন্নয়নের এই ধারা কি অব্যাহত থাকবে? বর্তমান অবস্থা নিয়ে জনমনে একটা সন্তুষ্টির ভাব আছে। জনগণ মনে করে ‘বর্তমান ভালো, ভবিষ্যৎ খারাপ।’ জনগণ অনেক সময় পরিবর্তনবিমুখ। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১১) সময় থেকে এ দেশে মানুষ ছিল পরিবর্তন-উন্মুখ। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই এই অবস্থা আছে। উৎপাদন বাড়ছে, ধনী লোকদের সম্পদ বাড়ছে, জনসাধারণ পরিবর্তনবিমুখ, নিদ্রামগ্ন। ফরাসি বিপ্লব থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয় পর্যন্ত কালে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে জনগণ ছিল জাগ্রত, পরিবর্তন-উন্মুখ, প্রগতি-উন্মুখ। এখন জনমন সে অবস্থায় নেই। এখন কায়েমি-স্বার্থবাদীদের শান্তি ক্রমাগত বাড়ছে।
নাচ-গান-বিনোদনকে যদি সংস্কৃতির অংশ ভাবা হয়, তাহলে সংস্কৃতির দিক দিয়েও বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতি করেছে। শিল্পী-সাহিত্যিকের সংখ্যা বিরাটভাবে বেড়েছে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র বাড়ছে। অনেক অনেক বই প্রতিবছর প্রকাশিত হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র এই ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। সব স্তরেই পরীক্ষার ফল অভাবনীয় রকম ভালো হচ্ছে। সরকারি লোকেরা শিক্ষার জাতীয় মান নিয়ে চিন্তা করতে একেবারেই অনীহ, তাঁরা কেবল বিশ্বমান অর্জনের জন্য উদ্গ্রীবতা প্রকাশ করে চলছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে, অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছে। এমসিকিউ ও সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে, ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে অভিভাবকেরা, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবিমুখ, পরীক্ষামুখী। শিক্ষার উন্নতি নিয়ে সরকারের ও সরকারি দলের লোকদের গর্বেরও প্রচারণার অন্ত নেই।
প্রশ্ন হলো, আসলেই কি শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতি হয়েছে? হচ্ছে? বিশ্বমান ব্যাপারটা কী? পশ্চিমা সভ্যতা তো সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই অবক্ষয়ক্লিষ্ট। ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির অন্ধ অনুসারী হয়ে বিশ্বমান অর্জনের নামে আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? ইঙ্গ-মার্কিন শক্তিরই-বা গন্তব্য কোথায়? বিশ্বায়নের নামে মানবজাতি কি ঠিক পথে চলছে? এই পরিবর্তনবিমুখতার, প্রগতিবিমুখতার পরিণতি কী হবে? স্পেংলার, সুইটজার ক্লাইভ বেল, রবীন্দ্রনাথ ও আরও অনেক মনীষী যে সভ্যতার সংকটের কথা বলেছিলেন, তার কি অবসান ঘটেছে? নতুন সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে? মার্ক্সবাদ নিয়ে যে আশা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, তা তো অবনিত! বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলেই কি সভ্যতা-সংস্কৃতি উন্নত হয়?
রাজনীতির অগ্রগতি কি সন্তোষজনক? ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতির যে অগ্রগতি, তার রূপ ও প্রকৃতি কী? অবশ্য এ কথা এখন বলা হচ্ছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে রাজনীতির উন্নতি হবে না, আর রাজনীতির উন্নতি চাইলে অর্থনীতির উন্নতি হবে না। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে রাজনীতির উন্নতি আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। রাজনৈতিক চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। জনমনকে এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়ছে ভোগের ও লোভের পিণ্ড: না হয় নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ভীতির শিকার। বাংলাদেশে ৪৫ বছর ধরে গণতন্ত্র কোথা থেকে কোথায় এগিয়েছে? সমাজতন্ত্র? ধর্মনিরপেক্ষতা? ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নিয়ে যে বিরোধ তার পরিণতি কী হবে? ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ তো দ্রুত ধর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে? জাতীয়তাবাদের অবস্থা কী? জাতীয়তাবাদী হলে কি কোনো দল বৃহৎ শান্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে গণতন্ত্রের জন্য ‘সাহায্য ভিক্ষা করতে যেতে পারে? যেতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে? বাংলাদেশে ৪৫ বছরে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কী হবে? সব দোষ কেবল সেনাশাসকদের ওপর চাপিয়ে, ‘সাম্প্রদায়িকদের’ ওপর চাপিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির ওপর চাপিয়ে আমরা কি ঠিক কাজ করছি? আমাদের কি আত্মসমালোচনার কোনো দরকার নেই?
আমরা নিজেরাও কি এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছেড়ে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের’ দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি না? আমরা কি সর্বজনীন কল্যাণের পথে চলছি? আমি সর্বজনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও অনুতাপহীন অপরাধীদের ধরছি না। ত্যাগ করে সহজ-সরলভাবে চিন্তা করতে ও কাজ করতে আমাদের শিখতে হবে। জাতীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং যুদ্ধ ও শান্তি পর্যবেক্ষণ করলে যে সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাই
তা হলো:
১. বাংলাদেশে আমরা এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছি। আমরা দুই-দুইবার স্বাধীনতা অর্জন করার পরও স্বাধীন হতে এবং সংকটকাল কাটাতে পারছি না। সংকট সর্বমুখী, সর্বগামী।
২. মানবজাতি সভ্যতার সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যে সংকটকালের সূচনা, মার্ক্সবাদ নিয়ে (১৮৪৮-১৯৯১) সেই সংকটকালে মানবজাতি কাটাতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর সভ্যতার সংকট গভীরতর রূপ নিয়ে সামনে এসেছে।
৩. মানবজাতি আজ ঘুমন্ত, গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আত্মসমালোচনা অবলম্বন করে আধুনিক যুগের অন্যায়-অবিচারের প্রতিকারের চেষ্টা না করে, ‘মৌলবাদবিরোধী’ আন্দোলন নিয়ে মধ্যযুগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মত্ত থাকার ফলে দুনিয়াব্যাপী আমাদের আধুনিকতা ব্যর্থ হচ্ছে—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ব্যর্থ হচ্ছে এবং আমাদের অজান্তেই আমরা মধ্যযুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি।
আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বিজয় দিবসে প্রশ্ন জাগছে মনে, এই জাতীয় বাস্তবতায় আমাদের করণীয় কী। আমাদের মধ্যে আমি যুদ্ধাপরাধী ও অনুতাপহীন অপরাধীদের ধরছি না।
নিদ্রাদশা কাটানোর জন্য আমাদের এবং গোটা মানবজাতির সংস্কারে, সচেতনভাবে সচেষ্ট হতে হবে নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টিতে। রেনেসাঁস হলো বৌদ্ধিক জাগরণ, চিন্তার ক্ষেত্রে জাগরণ। রেনেসাঁস কেবল জ্ঞানচর্চা দিয়ে হয় না। নতুন রেনেসাঁসের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের চর্চার সঙ্গে চরিত্র বলের—intellectual character অর্জনের অনুশীলনও অপরিহার্য। আগেকার রেনেসাঁসে ছিল মধ্যযুগের অনাচার ও অন্যায়-অবিচার থেকে আধুনিক যুগকে মুক্ত করার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি দ্বারা সর্বজনীন কল্যাণ সাধন। বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তন রেনেসাঁস-সাধকদের লক্ষ্য ছিল না। নতুন রেনেসাঁসের লক্ষ্য হবে আধুনিক যুগের অনাচার ও অন্যায়-অবিচার থেকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির নামে চলমান অনাচার ও অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি ও নবসৃষ্টি। Master Discourse ও Grand Narratives-এর দিন শেষ ইত্যাদি কথা সম্পূর্ণ ভুল। ক্ল্যাসিকের এবং আদর্শের অনুসন্ধান-অধ্যয়নকে বাদ দেওয়া যাবে না।
জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটিকে ইতিহাসের দিক দিয়ে গভীরভাবে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জাতীয়তাবাদ আর ফ্যাসিবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদ এক নয়। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে, পরাজিত রেখে, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে অবলম্বন করে বিশ্বব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে; যাতে সহজেই আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির কাজটি করা যায়। যুদ্ধ ও যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করার জন্যও তা ভূমিকা পালন করবে।
বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠনের পাশাপাশি জাতিরাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে হবে। ‘উদার’ গণতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সর্বজনীন’ গণতন্ত্রের ধারণা উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে রাজনৈতিক দল বিশেষ গুরুত্ব পাবে। দল সব সময় জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন ও জনজীবনের সমস্যাবলি সমাধানের কর্মসূচি প্রচার করে জনসমর্থন লাভের জন্য চেষ্টা করেন। দলের কার্যপ্রণালিতে অবলম্বন করা হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের নীতি। জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দ্বারা। সব জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আমার গণতন্ত্র ও নয়া গণতন্ত্র, রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বায়ক ও ভবিষ্যৎ বইতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে। এসব বিষয়ে সব জাতির মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা ও চিন্তা–ভাবনা দরকার। কেবল চিন্তায় হবে না, কাজ লাগবে এবং কাজের জন্য লাগবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল। বর্তমানে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো এ ধারায় চিন্তা করতে ও কাজ করতে উদ্যোগী হতে পারে। তা যদি না হয় তা হলে নতুন সংগঠন ও নতুন দল গঠন করতে হবে। গণজাগরণে যদি জনগণের মধ্যকার মহান সব মানবিক গুণের জাগরণ ঘটে, তবে জাতির জীবনে মহান লক্ষ্য ও মহান নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে। গভীরভাবে দেখলেও দেখা যায়, সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য জনগণই মহান নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে যায়। জনসমর্থন ছাড়া মহান নেতৃত্ব সম্ভব হয় না। আজ বিজয় দিবসে এসব কথা মনে জাগছে। এসব নিয়ে দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা আশা করি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।