২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সিনহা হত্যা: বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান চাই

গত ৩১ জুলাই কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। প্রায় দুই দশক ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে, এই ঘটনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিহতের গাড়ি থেকে কিছু ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের কথা বলা হয়। দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। কিন্তু ঘটনার পরদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’ ক্ষোভ প্রকাশ করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়, গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় অতিষ্ঠ জনগণও হয় প্রতিবাদী। নিহতের বোন বাদী হয়ে কক্সবাজারের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে টেকনাফ থানার ওসিসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্যকে আসামি করে নালিশি মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নেন, নির্দেশ দেওয়া হয় টেকনাফ থানায় মামলাটি নেওয়ার জন্য। আসামিরা আদালতে দ্রুত আত্মসমর্পণ করেন। র‌্যাবকে দেওয়া হয় তদন্তভার, তদন্ত চলছে। মামলার তদন্ত ও বিচারে প্রকৃত অপরাধীদের সাজা হবে, এটা চাইছেন সবাই।

আলোচনার বিষয় বিচারবহির্ভূত হত্যা। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। অবশ্য ২০০৯ সালের শুরুতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এ সংস্কৃতি চলমান ছিল। নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে আজকের ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের কর্মসূচি’তে বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করেছিল। সেই অঙ্গীকার রাখা হয়নি। দীর্ঘস্থায়ী গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভুলভ্রান্তির ভেতর দিয়ে মোটামুটি চলছিল ব্যবস্থাটি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর বিভিন্ন স্থানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ’৯১–পরবর্তী বিচারবহির্ভূত হত্যার সূচনা তখন থেকে। তবে বিস্ময়করভাবে সেসব হত্যা তখনকার মতো জনসমর্থন পেয়েছিল। নিহত ব্যক্তিদের অনেকে ছিলেন কিছু কুখ্যাত অপরাধী। কিন্তু এটা যে অপরাধ দমনের সঠিক পথ নয়, তা সরকারকে বোঝানো যায়নি। এর পেছনে অবশ্য আমাদের আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতা আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতারও ভূমিকা রয়েছে। অপরাধী গ্রেপ্তার হয়ে এজাহার ও অভিযোগপত্রের ফাঁকে কিংবা রাষ্ট্রপক্ষের নিষ্ক্রিয়তায় জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। এতে শঙ্কা বিরাজ করে মানুষের মধ্যে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাগুলো সে শঙ্কাকে তখনকার মতো দূর করলেও শাসনব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠন করা হয়। এটা পুলিশের আইনেই চলার কথা। সাংগঠনিকভাবেও সংস্থাটি পুলিশ বিভাগের আওতাধীন। র‌্যাব জঙ্গি দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে অপরাধ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। একপর্যায়ে নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায়ও জড়ায়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এর একটি বড় উদাহরণ। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারের আওতায় এসেছেন। এখন বিষয়টি উচ্চ আদালতের আওতায়। কিন্তু এ ধরনের কার্যক্রম সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা আমাদের নজরে আসেনি। বরং প্রবণতাটি পুলিশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

অর্থনীতি, ভূরাজনীতি ও পর্যটন—এসব বিবেচনায় কক্সবাজার দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এ জেলার উখিয়া ও টেকনাফে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে। চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধী চক্রের গমনাগমনের পথ এটি। সাগরের পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেঁষে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ। এ সড়কে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ক্যাম্পও আছে। তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ বা তল্লাশি করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সড়কে রাতের বেলা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা অনেক ঘটে। মানুষ সবকিছু জেনেও মুখ খুলত না। নিহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ মাদক পাচার বা এ–জাতীয় অপরাধে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিচারের আওতায় না এনে মেরে ফেলার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেদের প্রাণ ও অস্ত্র রক্ষা কিংবা সরকারি সম্পদ রক্ষা অথবা আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি রোধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একতরফা গুলি চালাতে পারে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটবে। সেটা অযৌক্তিকও হবে না। তবে এর যৌক্তিকতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাহী তদন্তের বিধান রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত। কিন্তু থেমে নেই বিচারবহির্ভূত হত্যা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা শুরুতে এটাকে বলত ‘ক্রসফায়ার’, পরে নাম দেয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’। একেবারেই গতানুগতিক ধারার গল্প। সত্যি বলতে কি, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধও শেষ দিকে হচ্ছিল ক্ষীণ কণ্ঠে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে টেকনাফেই ২০১৮ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক এভাবে নিহত হন। নিহত হওয়ার একটু আগে টেলিফোনে স্ত্রীর সঙ্গে একরামুলের কথোপকথন রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড তাঁর স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেন। কিন্তু আজও বিচার হয়নি।

মেজর (অব.) সিনহা সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন। কর্মকালে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। যতটুকু জানা যায়, অবসরের পর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। টেকনাফ থেকে শুটিং শেষে রাতের বেলা কক্সবাজারে ফিরছিলেন একজন সঙ্গীসহ। গাড়ি চালাচ্ছিলেন নিজে। সড়কে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশে তিনি গাড়ি থামান এবং দুই হাত উঁচু করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিকে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। সর্বোচ্চ দুই মিনিটের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে রয়েছে কয়েকটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। ডাকাত ভেবে ভুল করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি আসামিদের। ডাকাতও আওতায় চলে এলে মেরে ফেলা যায় না। যা–ই হোক, এসব বিষয় তদন্তে বের হয়ে আসবে। নিষ্পত্তি হবে আদালতে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলাটিও দেশে সাড়া ফেলেছিল। তখন আশা করা হয়েছিল, এ–জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। কিন্তু বন্ধ হয়নি। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, পুলিশ বাহিনীর অতিরাজনীতিকরণের ফলে তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। অন্যদিকে তাঁদের এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করার জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগও ছিল না।

তবে এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। নিহত ব্যক্তি সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাঁদের সংগঠন রাওয়ার সোচ্চার দাবি সরাসরি উপেক্ষার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী প্রধান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সেখানে গিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র‌্যাবের মহাপরিচালক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ঘটনা তদন্ত করছে। তবে বিচারিক কাজের জন্য আবশ্যক হবে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবের অভিযোগপত্র এবং আদালতে বাদীপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও আলামত।

আমরা চাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই আদালত রায় দিয়ে থাকেন। এবারও তা–ই হবে। কিন্তু এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা মাসাধিক কাল বন্ধ আছে। এটা খুবই ইতিবাচক। আমরা চাই সুদক্ষ ও সক্রিয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা; তারা চলবে আইনের আওতায়। সে পরিপ্রেক্ষিতেই আশাবাদ যে মেজর সিনহা জীবন দিয়ে এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার হিড়িক বন্ধ করার রাস্তা রেখে গেছেন, এগোতে হবে সেই পথ ধরে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]