সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আজ শনিবার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। গত মাসে বার্ধক্যের কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম আলোয় কলাম লিখেছিলাম ‘বিচারপতির প্রতি আমরা কতটা সুবিচার করেছি’। তখনো ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আমরা তাঁকে হারাব?
ওই লেখার পর সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনাসহ অনেকেই টেলিফোন করে সাহাবুদ্দীন আহমদের খোঁজ নিয়েছেন। সুস্থতা কামনা করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা বিরোধী দল বিএনপির কেউ তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন কিংবা এর আগে বাড়িতে খোঁজখবর নিয়েছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা হলো দলের বাইরের সবকিছু অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করা।
সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। যদিও সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন। সেই থেকে তিনি নিজ বাসায় প্রায় স্বেচ্ছাবন্দী জীবন কাটিয়েছেন। আমরা এমন সমাজ করেছি, যেখানে সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখা হয়। দলের বাইরে সবকিছু শত্রু শত্রু মনে হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদ এ দেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে। এই মানুষটির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাহাবুদ্দীন আহমদ কেমন মানুষ ছিলেন, আইন অঙ্গনের লোকজনই ভালো জানেন। তবে আইন অঙ্গনের বাইরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও দেশের গণতন্ত্র উত্তরণে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৪ সালে প্রয়াত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন খ্যাতনামা লেখক। বিচিত্র বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও গবেষণায় আগ্রহ ছিল। তিনি কোরআন শরিফের সরল বঙ্গানুবাদ করেছেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সেই অর্থে লেখক ছিলেন না। তবে তাঁর ভাষণগুলো নিয়ে একটি বই আছে—‘গণতন্ত্রে উত্তরণ: গণতন্ত্র বিনির্মাণ’। তাঁর কলেজশিক্ষক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইনই ছিলেন এর উদ্যোক্তা। কিশোরগঞ্জের গুরু দয়াল কলেজে তিনি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ছাত্র হিসেবে পান। সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন সেই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন: বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজনীতিক নন। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ বিধানে তাঁকে রাজনীতি ও রাজনীতিক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে। ...তবে তিনি রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেকে নিরপেক্ষতার এমন এক দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। (সূত্র: গণতন্ত্রে উত্তরণ, গণতন্ত্র বিনির্মাণ: বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ মাওলা ব্রাদার্স, ফেব্রুয়ারি ২০০০)
সর্বত্র দলীয় বিভাজন ও বিদ্বেষে অভ্যস্ত আমাদের রাজনীতিকেরা সেই নিরপেক্ষতাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেননি। এ কারণে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দায়িত্ব পালনকালে। ১৯৯১ সালের ৫ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সাহাবুদ্দীন বলেছিলেন, ‘সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টামাত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করা আমি প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই মন্ত্রিপরিষদের কোনো কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালিত হোক—এটাই আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা।’
১৯৯০ সালের শেষ দিকে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। এরশাদ চেয়েছিলেন ক্ষমতায় থেকে তিনি আরেকটি নির্বাচন করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও পাঁচদলীয় বাম জোট তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে এরশাদ ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, কারফিউ জারি করেন। কিন্তু মানুষ তাঁর নির্দেশ মানেনি। তারা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি অবিচল আস্থাশীল সাহাবুদ্দীন আহমদ কখনোই সেই অধিকার প্রয়োগ করেননি। তিনি চেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হোক। তিনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনো বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বিএনপি নেতা ও তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথাবার্তা বললে তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর কড়া জবাব দেন। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর পদাধিকারীরাও সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে আগের দায়িত্বে ফিরে যান। বিস্ময়কর হলো, সে সময় বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটুকু করেননি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। বিএনপি আমলের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস। তিনি ছিলেন দলীয় নেতৃত্বের প্রতি কঠোরভাবে অনুগত। একবার প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় প্রকাশ করলে আবদুর রহমান বিশ্বাস নাকি নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দিকে রওনা হয়েছিলে। কিন্তু তাঁর প্রটোকলে থাকা কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতিকে নিবৃত্ত করেন। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছিল, তারা এমন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করতে চান, যাঁর প্রতি সবার শ্রদ্ধা ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে তিনি রাজি হননি।
পরে শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলো যে তিনি রাজি না হলে তাঁর বাড়ির সামনে বসে অনশন করবেন। শেষ পর্যন্ত সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। যদিও তিনি জানতেন, ‘কবর জিয়ারত ও মিলাদ পড়া’ ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই।’
আওয়ামী লীগ শাসনামলের পাঁচ বছর সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো মতভেদ হয়নি। একবার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সাময়িক হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার কথা বলেছিলেন। দলের নেতারা এর প্রতিবাদ করলেন। পরে রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আর কথা বলেননি। তাঁর পরামর্শেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছিল। ফলে, বিচার প্রলম্বিত হলেও এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি।
গোল বাধে সরকারের শেষ সময়ে ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দলের নেতারা অন্যায়ভাবে এর দায় চাপালেন সাহাবুদ্দীন আহমদের ওপর। আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানিয়েছিল।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনপ্রিয়তাকে চিরস্থায়ী ভাবেন। জনগণের মন বুঝতে চেষ্টা করেন না। বিএনপি যেমন ২০০৮ সালের নির্বাচনকে সাজানো আয়োজন বলে মনে করে, তেমনি আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনকে ভাবে তাদের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র তারা আগে বুঝতে পারল না কেন? আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বিকেল চারটায়, অর্থাৎ ভোট গ্রহণের শেষ সময়ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে বলেছিলেন, ‘খুব ভালো ভোট হয়েছে।’ খুব ভালো ভোটে উল্টো ফল হলে সেই দায় কীভাবে ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতির ওপর বর্তায়?
২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন। সেই থেকে তিনি নিজ বাসায় প্রায় স্বেচ্ছাবন্দী জীবন কাটিয়েছেন। আমরা এমন সমাজ করেছি, যেখানে সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখা হয়। দলের বাইরে সবকিছু শত্রু শত্রু মনে হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদ এ দেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে। এই মানুষটির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি