বিচারক নিয়োগ নিয়ে তোলপাড়

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টছবি: রয়টার্স

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ বহু দেশে মামুলি বিষয়। যেমন বাংলাদেশে এসব নিয়োগ নিয়ে এখন তেমন কোনো আলোচনা হয় না। তবে আমেরিকার চিত্র ভিন্ন। সেখানে সরকারের প্রতিটি স্তরে রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। তাই প্রতিটি বড় নিয়োগের আগে রয়েছে যাচাই-বাছাই আর বিতর্কের সুযোগ। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ নিয়ে এসব আরও বেশি হয়। কারণ, প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের কার্যক্রমের বৈধতা পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে এর রয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা।

বিচারক নিয়োগ নিয়ে অনুন্নত গণতন্ত্রের অনেক দেশে একাডেমিক আলোচনা করার পরিবেশ পর্যন্ত নেই। আদালত অবমাননা, মানহানি, তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত বিভিন্ন আইনে এমন আলোচনাকে নিরুৎসাহিত বা ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়। কিন্তু মুক্ত গণতন্ত্রের দেশে এসব আলোচনা হয় খোলামেলা এবং এতে নতুন নিয়োগের সুদূরপ্রসারী প্রভাবকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমেরিকার বিচারক নিয়ে এখনকার বিতর্ক।

উচ্চ আদালতের নিয়োগের সঙ্গে জড়িত সমাজের প্রতিটি মানুষের স্বার্থের প্রশ্ন। কারণ, উচ্চ আদালত সরকারের অন্য দুটি বিভাগের (পার্লামেন্ট ও নির্বাহী বিভাগ) অন্যায্য কাজ থেকে শুধু নয়, নিম্ন আদালতে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাগরিকদের শেষ রক্ষাকবচ

২.

গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে এখন আটজন বিচারক রয়েছেন। পাঁচজন রক্ষণশীল রিপাবলিকান আমলে নিয়োগ পাওয়া, তিনজন তুলনামূলক উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটদের আমলে। কিন্তু এ পাঁচজনের মধ্যে একজন (জন রবার্টস, প্রধান বিচারক) ইতিমধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় ডেমোক্র্যাটদের আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের সঙ্গে একমত হয়ে রায় দিয়েছেন। মামলাটি ছিল ওবামা আমলে প্রণীত স্বাস্থ্যবিমা–সংক্রান্ত আইনের বৈধতা নিয়ে। ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত এ আইনে আমেরিকার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ অনেক বাড়ানো হয়েছে। রিপাবলিকানরা, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর কঠোর সমালোচক।

রিপাবলিকানরা এখন তাই চাইছেন গিন্সবার্গের জায়গায় নিশ্চিতভাবে রক্ষণশীল একজন বিচারক নিয়োগ দিতে। এটি করা গেলে ভবিষ্যতে ওবামাকেয়ার বাতিল করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া ১৯৭৩ সালের একটি মামলার রায় বাতিল করা এবং আরও বহু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে (যেমন অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ, উগ্রবাদ দমন, অস্ত্র বহন) রিপাবলিকানদের অনুকূলে রায় পাওয়া। আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনি লড়াই হলে সেখানেও রিপাবলিকানদের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইছেন ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বিচারক নিয়োগের কাজটি সেরে ফেলতে। আমেরিকার সংবিধান অনুসারে তাঁর সে ক্ষমতা রয়েছে। তাঁর মনোনীত প্রার্থীকে সিনেটের ভোটে অনুমোদিত করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতাও তাঁর দলের রয়েছে। তাহলে এ নিয়োগের উদ্যোগ নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

প্রাথমিক বিতর্কটি নিয়োগের সময় নিয়ে। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি শূন্য পদে তখনকার প্রেসিডেন্ট ওবামা নিয়োগ দিতে গেলে সিনেট (আমেরিকার আইনসভার উচ্চকক্ষ) অস্বীকৃতি জানায়। রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটের বক্তব্য ছিল, নির্বাচনী বছরে এটি করা হলে নতুন প্রেসিডেন্ট এবং প্রকারান্তরে ভোটাররা তাঁদের পছন্দমতো নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। ডেমোক্র্যাটরা এখন একই যুক্তি দিয়ে ট্রাম্প ‍ও রিপাবলিকান পার্টিকে বিরত রাখতে চাইছেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা এবার যুক্তি দিচ্ছেন, ২০১৬ সালে ওবামা ছিলেন দ্বিতীয় মেয়াদের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট, অন্যদিকে ট্রাম্পের রয়েছে আবারও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ। তাঁরা বলছেন প্রেসিডেন্টের মনোনীত বিচারককে নির্বাচনী বছরে সিনেটে অনুমোদন দেওয়ার বহু নজিরও রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন বিচারকের নাম ঘোষণা দেবেন শনিবার। সম্ভবত ফেডারেল আপিলেট জাজ অ্যামি কোনি বারেট এবার তাঁর মনোনয়ন পাবেন। ফেডারেল আপিল কোর্টে ২০১৭ সালে তাঁকে মনোনয়নের সময় ডেমোক্র্যাটরা গর্ভপাতের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ও তাঁর গোঁড়া ক্যাথলিক বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এটি তাঁকে রক্ষণশীলদের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। অন্যদিকে কিউবান-আমেরিকান বিচারক বারবারা লাগোয়াকে মনোনয়ন দিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোরিডা রাজ্যে ট্রাম্পের জেতা সহজ হবে।

শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন যিনিই পান, সিনেটে তাঁর পক্ষে ভোটদান প্রায় নিশ্চিত এখন পর্যন্ত। সিনেটে রিপাবলিকানদের সদস্য ৫৩ জন, ডেমোক্র্যাটদের ৪৭ জন। দুজন রিপাবলিকান সিনেটর ইতিমধ্যে মনোনয়নের বিপক্ষে ভোট দেবেন বলেছেন। আরও একজন রিপাবলিকান পক্ষত্যাগ করলেও ভাইস প্রেসিডেন্ট নিষ্পত্তিকারী ভোট দিতে পারবেন। তবে সে সম্ভাবনা কম।

ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য চেষ্টা চালাবেন নিয়োগদানকে অন্তত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত বিলম্বিত করতে। সেটি করতে পারলে এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আসতে পারলে নতুন নিয়োগের বিরুদ্ধে নৈতিক চাপ বাড়বে।

৩.

এবার বিচারক নিয়োগ দিতে পারলে এটি হবে সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের মনোনীত তৃতীয় বিচারক। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এঁদের প্রত্যেকের বয়স এত কম যে আমেরিকানদের গড় আয়ু অনুসারে বেঁচে থাকলে এরা প্রায় ৩০ বছর সুপ্রিম কোর্টে থাকবেন। বিচারক হিসেবে কার্যরত (নিল গোরসেচ ও ব্রেট কাভানা) এবং মনোনয়নে এগিয়ে থাকা (বারেট ও লাগোয়া) প্রত্যেকের বয়স ৫০-এর আশপাশে। অন্য আমলে নিয়োগ পাওয়া তিন রিপাবলিকান বিচারকের বয়স ৬৫, ৭২ ও ৮২।

আগামী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা (প্রেসিডেন্ট পদে ও সিনেটে) জিতলেও, উপরিউক্ত অন্তত দুজন বিচারকের আসন শূন্য না হওয়া পর্যন্ত (মৃত্যু বা অবসরের কারণে) সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের মতাদর্শের বিচারকদের প্রাধান্য থাকবে না। তার মানে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের প্রণীত সিদ্ধান্ত, নীতি ও আইন মামলা সাপেক্ষে বাতিল করে দিতে পারবেন সুপ্রিম কোর্ট।

বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের আরেকটা বড় কারণ এটা। যদি রিপাবলিকান পার্টি সুপ্রিম কোর্টের শূন্য আসনে নিয়োগ দিয়ে ফেলে, ডেমোক্র্যাটরা জিতে এলে নিতে পারেন নানান পাল্টা পদক্ষেপ। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারেন, এমনকি পারেন বিচারকদের মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিতে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ডেমোক্র্যাটরা এসব করার উদ্যোগ নিলে দীর্ঘদিনের মীমাংসিত বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে তা।

৪.

উচ্চ আদালতের নিয়োগের সঙ্গে জড়িত সমাজের প্রতিটি মানুষের স্বার্থের প্রশ্ন। কারণ, উচ্চ আদালত সরকারের অন্য দুটি বিভাগের (পার্লামেন্ট ও নির্বাহী বিভাগ) অন্যায্য কাজ থেকে শুধু নয়, নিম্ন আদালতে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নাগরিকদের শেষ রক্ষাকবচ। আমেরিকায় সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এই উপলব্ধি থেকে। এটি তাই অনভিপ্রেত কিছু নয়। এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। এটি উচ্চ আদালতে নিয়োগ নিয়ে যেকোনো দেশে যাচাই-বাছাই ও বিতর্কের সুযোগ অবারিত করার আবশ্যকীয়তাও তুলে ধরেছে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক