২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিএনপির ৭ মার্চ: চক্র ভাঙতে পারবেন কি মির্জা ফখরুল?

যতবারই বাংলাদেশ, বাংলা ও বাঙালির কথা আসবে, ততবার বঙ্গবন্ধুর কথা আসবে

বিএনপির বরাবরের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলে। কিন্তু এই প্রশ্নও তো আসে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে অজস্র মুক্তিযোদ্ধা দলে নিয়েও বিএনপি কেন মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের অর্জনের খাতায় তুলতে পারল না? মুক্তিযুদ্ধের পুঁজি তাদেরও কম ছিল না। কিন্তু সেই পুঁজি ভেঙে ‘রাজাকার’ ক্রয় করে কী লাভ হয়েছে তাদের! এ যেন শুধু জানালার লোভে বেচে দিলাম ঘর-দরজা!
কিন্তু হাওয়া বোধ হয় ঘুরতে শুরু করেছে। বিএনপি তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৭ মার্চ দিবস পালন করেছে। অবশ্যই সেই দিবসের ভাব বা ভাষা সরকারি কায়দায় হওয়ার নয়; হয়ওনি। কিন্তু মহাসচিব যা বলেছেন, তা ইতিহাস হওয়ার মতো। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ঠিক একইভাবে ৭ মার্চ যে ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমানের, সেটা অবশ্যই ইতিহাস। অবশ্যই তাঁর মর্যাদা তাঁকে দিতে হবে…কাউকেই খাটো করার কোনো রকম ইচ্ছা আমাদের নেই এবং আমরা বিশ্বাস করি সেটা উচিতও না। বিশেষ করে স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রকৃত সত্য সবাইকে উদ্‌ঘাটিত করতে হবে।’

এই স্বীকারোক্তির মধ্যে সততা আছে, সত্যের বলিষ্ঠতা আছে। বহুদিন হলো রাজনৈতিক নেতারা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রাখছেন না। বহুদিন হলো হিংসা ভিন্ন আর কোনো কথা নেই। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বকেয়া পাওনা পরিশোধে বিএনপির সদিচ্ছা গণতান্ত্রিক সহনশীলতার পথে ছোট হলেও সম্ভাবনাময় পদক্ষেপ। প্রথম পা ফেলেই শিশু অনেক দূর যায় না, কিন্তু হাঁটতে শেখার ওই প্রথম পদক্ষেপ তাকে জীবনের মাটিতে দাঁড় করায়। ক্ষমতাসীন দলের কথিত কূটকৌশলে নাস্তানাবুদ বিএনপির জন্য এই প্রথম পদক্ষেপ রাজনৈতিক সাবালকত্ব সদাচারের লক্ষণ।

রুশ বিপ্লবে লেনিনের অবিসংবাদী অবস্থান কেউ অস্বীকার করেনি। করলে কিছুটা করতে পারতেন লিও ট্রটস্কি। তিনি বিপ্লবকালীন গৃহযুদ্ধের সামরিক নেতা, শিল্প ও রেল বিস্তারের নায়ক। অথচ তিনি লেনিনের বলশেভিক গোষ্ঠীর কেউ নন। লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ছিল। সেই ট্রটস্কি লিখেছেন, ‘…যখন তাঁকে দেখি, তাঁর কপালের রেখায়, গভীর চোখের চাহনিতে আর দৃঢ় ঠোঁটের ভাঁজে আমি পাঠ করেছিলাম রাশিয়ার ভবিষ্যৎ।’ ম্যাক্সিম গোর্কি মনে করতেন, ‘সময়ের থেকে বহুদূর অবধি দেখতে পেতেন লেনিন।’

একই কথা বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও খাটে। তাঁর জীবনসংগ্রামই জাতীয় স্বাধীনতার একেকটি অধ্যায়। তাঁর কপালের বলিরেখায় ছিল মুক্তির সংকল্প, তাঁর বক্তৃতারত ঠোঁটের দৃঢ়তায় ছিল বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জেদ। এমনকি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে এক নিবন্ধে জিয়াউর রহমানও লিখেছিলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম।’ এতকাল পরে মির্জা দলের প্রতিষ্ঠাতার ভাষাতেই কথা বলেছেন। মির্জা ফখরুল অবশ্য আরও বলেছেন, ‘আপনি যখন ৭ মার্চ পালন করবেন, তখন বলবেন ৭ মার্চের ডাকে সব হয়ে গিয়েছিল। সেটা কি না, তা আলোচনার মধ্যে আসবে, ইতিহাস থেকে আসবে, ইতিহাসের সমস্ত বই থেকে আসবে।’ তথ্যপ্রযুক্তির কালে দেশের অধিকাংশ তরুণই যখন শিক্ষিত, তখন মাত্র ৫০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি টিকিয়ে রাখার সুযোগ কম।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিছু ‘পুঁজি’ তো বিএনপিরও আছে। জিয়াউর রহমানের আমলেই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হিসেবে স্বাধীনতা পদকের রেওয়াজ শুরু হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সময়ে এই পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন; মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. মুহাম্মদ ইব্রাহিম, শিল্পী রুনা লায়লা, কবি জসিমউদ্‌দীন, কবি শামসুর রাহমান, রণদাপ্রসাদ সাহা, সুরকার সমর দাস, সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোতাহার হোসেন, ফিরোজা বেগম, পটুয়া কামরুল হাসান, শহীদ মুনীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি ফররুখ আহমদসহ অনেকে।

খালেদা জিয়ার সরকার রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তারপরও ১৯৯১ সালের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি বিএনপির আচরণ শত্রুজ্ঞানে ভজনার মতো। বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনিতে চাঁদ সওদাগর নিতান্ত বাধ্য হয়ে সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে মনসা দেবীকে বাঁ হাতে পূজা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ইতিহাসের প্রতি বিএনপির এই খুঁতযুক্ত ভজনার নিট ক্ষতি হলো: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতীয় মীমাংসা না হওয়া; তা একটি দলের একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকা। বিএনপির এই কপটতার সুযোগ পুরোপুরি নেয় জামায়াত। জামায়াত হচ্ছে সেই জানালা, যাকে পাওয়ার জন্য বিএনপি জনগণের কাছে যাওয়ার দরজাটিই খোয়াতে বসেছে। ফকির লালন সাঁই তো গেয়েই রেখেছেন: ‘থাকতে রতন ঘরে, এ কি বেহাত আজ আমারি/ আপন ঘরে পরের সংসার, আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর’।

১৯৭১ সালে বিএনপি ছিল না, তাই সে সময় দল হিসেবে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে যাঁর যা অবদান, তা স্বীকারে বিএনপির লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। এতে মুক্তিযুদ্ধের দলীয়করণ কমবে এবং আখেরে কৌশলগত লাভ হবে বিএনপিরই। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ভাগ তাদেরও পাওনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সমালোচনা করতে গিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে তাঁর অবিসংবাদী ভূমিকাকে অস্বীকার করা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ করার মতো ব্যাপার। এতে বিএনপি নিজেই বঞ্চিত হয়েছে। যতবারই বাংলাদেশ, বাংলা ও বাঙালির কথা আসবে, আসবে বাঙালি মুসলমানের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায়ের কথা; ততবার বঙ্গবন্ধুর কথা আসবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর সংগ্রামী জীবন ও মর্মান্তিক মৃত্যু থেকে দেশপ্রেমের আবেগ সংগ্রহ করবে। তিনি দলীয় নন, তিনি জাতীয়। তাঁকে নিয়ে দোনোমনা বিএনপির সার্বভৌমত্বের রাজনীতির পথের কাঁটা হয়েই থাকবে।

বিএনপিকে ইতিহাসের এই গোলকধাঁধা থেকে বের করতে পারবেন কি মির্জা ফখরুল?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]