২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বিএনপির পথেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ

সম্প্রতি এক সামাজিক অনুষ্ঠানে দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হালচাল নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই আলোচনার মাঝপথে একজন বললেন, আওয়ামী লীগ তো বিএনপির রাজনীতিকে কঠিন করে দিল। সবাই তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। ভাবলেন, বিএনপি যে হরহামেশা অভিযোগ করে থাকে সরকারের দমন-পীড়ন, হামলা-মামলার কারণে তারা মাঠে নামতে পারছে না; ভদ্রলোক তারই প্রতিধ্বনি করছেন কি না।

অন্যরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন, সরকার বিএনপির রাজপথে নামা বন্ধ করায় তার রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়েনি। বিএনপির রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়েছে অন্য কারণে। অতীতে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মত ও পথের যে ফারাক ছিল, তা ক্রমেই ঘুচে যাচ্ছে। এখন পার্থক্যটা কেবল কথা ও স্লোগানে, নীতিতে নয়। সোজা কথায়, আওয়ামী লীগ বিএনপির রাজনীতি অনেকটা আত্মসাৎ করে ফেলেছে।

এরপর ভদ্রলোক ব্যাখ্যা করে বললেন, অতীতে আওয়ামী লীগের নীতি ও বিএনপির নীতি এক ছিল না। মোটাদাগে দুই দলের সমর্থক গোষ্ঠীও আলাদা ছিল। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল, বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যথাক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের কথা বলত। নেতারা জোরগলায় প্রচার করতেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে বিএনপি সংবিধানের মূলনীতিকে ধ্বংস করেছে। সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে একে বিকৃত করেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দল করায় জনগণের দল না হয়ে আমলা ও প্রশাসননির্ভর দল হয়েছে।

সত্য যে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি সংবিধানে অনেক কাটাছেঁড়া করেছে। কিন্তু তারা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বসাতে সাহস পায়নি। সেই কাজটি করেছেন বিএনপিকে হটিয়ে জবরদস্তিভাবে ক্ষমতায় আসা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সব ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করলেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানে হাত দেয়নি। যুক্তি দেখিয়েছে, সংবিধান পরিবর্তন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের নেই। কিন্তু ২০০৯ সালে যখন দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এল, তখনো এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করেনি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র তারাও অক্ষুণ্ন রেখেছে। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরেক চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হলো। ধর্মনিরপেক্ষতাও পুনঃস্থাপন করা হলো। আবার রাষ্ট্রধর্মও রেখে দেওয়া হলো।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পার্থক্য হলো প্রথমটি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং দ্বিতীয়টি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ ছিল পুরোপুরি বাঙালিত্বের চেতনাপ্রসূত। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টিও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধকে তাদের মূলনীতি হিসেবে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিএনপির কঠোর সমালোচনা করলেও জাতীয় পার্টির বিষয়ে নিশ্চুপ। তাঁরা এ কথা বুঝতে চান না যে পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে জনগণকে যেভাবে জাগানো যেত, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা জাতীয়তাবাদের বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছি। এখন জাতীয়তাবাদ বিতর্কের চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা ও সুশাসনের ঘাটতি।

অতীতে আমরা দেখেছি ক্ষমতায় থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনকে ব্যবহারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ পিছিয়ে ছিল না। এখনো নেই। ১৯৮৬ সালে এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই বিরোধী দলের আসনে বসেছিল।

সংবিধানে সমাজতন্ত্র নামে যে মূলনীতি আছে, প্রকৃতপক্ষে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা কোনো দল করেনি। আর বর্তমানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে কোনো ফারাক নেই। তিন দলই মুক্ত অর্থনীতির ঘোরতর সমর্থক। একসময় অভিযোগ করা হতো, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ব্যবসায়ী ও সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলানির্ভর দল। এখন কেবল সংসদ নয়, দল হিসেবেও আওয়ামী লীগে এঁদের প্রাধান্য বেশি। একদা জনমুখী (বঙ্গবন্ধুর ভাষায় দুঃখী মানুষের দল) আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ীমুখী হয়েছে। বর্তমান সংসদের ৬২ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আরেকটি ফারাক ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের বঞ্চিত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। এ কারণে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, জিয়াউর রহমান ও বিএনপিই এ দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেছে। কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু গত ১৪ বছর তো বিএনপি ক্ষমতায় নেই। তাহলে এখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালাচ্ছেন কারা?

অতীতে আমরা দেখেছি ক্ষমতায় থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনকে ব্যবহারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ পিছিয়ে ছিল না। এখনো নেই। ১৯৮৬ সালে এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই বিরোধী দলের আসনে বসেছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়, তাতে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও অংশ নিয়েছিল। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল (যদিও বিএনপির একগুঁয়েমির জন্য সেই নির্বাচন হয়নি এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি বাতিল করে)।

হেফাজতে ইসলাম নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নারী উন্নয়ন নীতিসহ আরও অনেক সেক্যুলার নীতির বিরোধিতা করে। মহাসমাবেশের নামে সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় ভয়াবহ তাণ্ডব করেছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপির প্ররোচনায় হেফাজত মাঠে নেমেছিল। তবে প্ররোচনা কেবল বিএনপি দেয়নি, দিয়েছিল মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিও। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ হেফাজতের দাবি মেনে শুধু কওমি মাদ্রাসাশিক্ষাকেই স্বীকৃতি দেয়নি, সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যবইও রদবদল করেছে। সরকারের একজন জুনিয়র মন্ত্রী বলেছেন, ওদের পক্ষে লোক আছে বলে সরকার দাবি মেনে নিয়েছে। ওদের বিরোধী পক্ষের জনসমর্থন থাকলে তাদের কথা তাঁরা শুনবেন। তাহলে আওয়ামী লীগের নিজের নীতিটা কী।

অতীতে বিএনপিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মিত্র ভাবা হতো, আর আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের। সাম্প্রতিক কালে সেই সমীকরণও পাল্টে গেছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ ধর্মভিত্তিক দল পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। সম্মিলিত ইসলামী জোট ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ) আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০১৮)। পার্বত্য চট্টগ্রামে সম–অধিকারের নামে বাঙালিদের যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেসব সংগঠনেও স্থানীয় বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় আছেন। পার্বত্য চুক্তি সইকারী ও বিরোধিতাকারীদের মধ্যে আশ্চর্য সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিএনপির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, দেশ পরিচালনায় তারা দলীয় জনগণের ওপর নির্ভর না করে প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সীমাবহির্ভূত কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে আওয়ামী লীগও আর জনগণের ওপর ভরসা না রেখে তাদের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ বিএনপির গৃহীত নীতিই আওয়ামী লীগ প্রায় সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করে চলেছে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]