আবার আন্দোলনের জোট গঠনের দিকে এগোচ্ছে বিএনপি। যদিও জোটভাগ্য ভালো না তাদের। ২০১২ সালের বিশ দলীয় জোট সফল হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া জোটচর্চা শুরু করেছিল। কিন্তু নির্বাচন আসতে আসতে তা হযবরল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে বরং আওয়ামী লীগের রেকর্ড উত্তম। আওয়ামী লীগ যতবারই জোট গঠন করে আন্দোলনে গেছে, সফল হয়েছে। নির্বাচনী জোট বানানোর ব্যাপারেও দলটির ওস্তাদির ধারেকাছে বিএনপি নেই। আওয়ামী লীগ যখন জাগে তখন এক সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনেক সংস্থাকে তারা জাগাতে পারে। বিপরীতে বিএনপির সাফল্য বেশিটাই একক সাফল্য। কিন্তু গত এক দশকে কোণঠাসা হয়ে থাকা এই বৃহৎ দলটির আর একা চলার উপায় নেই। জোট তাদের অস্তিত্বেরও প্রয়োজন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখতেও এর দরকার রয়েছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে একা করে দিতে পেরেছিল, এখনো পারছে; বিএনপি সেভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে একা করে দিতে পারবে? সেরকম জোট গঠনের বাস্তবতা কি আছে?
এবারে বিএনপি’র জোট গঠনের মালমসলা আগের চেয়ে আলাদা বলেই মনে হচ্ছে। আপাতত গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে দুটি মধ্যবাম দলের সঙ্গে তাঁদের ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ মধ্যডান বিএনপি আরও ডানপন্থীদের সঙ্গে জোট গড়ার চেয়ে মধ্যবামদের প্রতিই আগ্রহী। এই মধ্যবামদের সঙ্গে আবার রেজা-নুরুদের মধ্যডান গণ অধিকার পরিষদসহ নাগরিক ঐক্য ও গণফোরামের মতো মধ্যপন্থীদেরও মেলামেশা আছে। কিন্তু এই জোটের পরিণতিও যতটা গর্জায় ততটা বর্ষায় কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকছে। সন্দেহের জন্য দুটি কারণই যথেষ্ট।
প্রথমত, এটা কি নির্বাচনী জোট, নাকি আন্দোলনের জোট? বাংলাদেশের ইতিহাস দেখায়, গণ-আন্দোলনে জয়ী না হয়ে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনেও জয়ী হয় না। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে বিজয়ীরাই ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ৯০-এর গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে আপসহীনেরাই ’৯১ সালে সরকার গঠন করেছে। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের যে লক্ষ্য বিএনপি নিয়েছে, সে জন্য তাদের আগে মাঠের আন্দোলনে জয়ী হতে হবে। সেই লক্ষ্য হাসিলে ছোট বাম দলগুলো তেমন ভরসা হবে না। হওয়ার কথাও না। বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয় সেটা বোঝেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি কোনো কারণে নির্বাচন বর্জন করলে কি জোটের বন্ধুরাও চূড়ান্ত পথ নিতে রাজি থাকবেন? নাকি তখন বিএনপিকে আবারও একাই লড়াই করে মার খেতে হবে? এ দুটি বিষয়ে উত্তরটা ভবিষ্যতের খাতাতেই তোলা থাকুক।
রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির দরকার জামায়াত বা জাতীয় পার্টির মতো সঙ্গীদের। এদের কিছু ভোট রয়েছে, কিছু কিছু এলাকায় তারা দাপটও দেখাতে সক্ষম। বড় দলকে এদের বাদ দিয়ে তবে কেন ছোটদের দুয়ারে ধরনা দিতে হচ্ছে? প্রথমত, জামায়াত নিয়ে দেশের ভেতরের ও বাইরের অনেকের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি রয়েছে বিএনপির ভেতরেও। অতীতে ‘মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতার’ যে বদনাম বিএনপি কামিয়েছে, তা ঘোচানোর খাতিরেও তাদের বাম ও সেক্যুলারদের সঙ্গে ওঠ-বস দেখাতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার হেফাজতে ইসলামের মতো করে জামায়াতকে যুগপৎ লাঠির ভয় আর মুলার লোভ দিয়ে খেলাতে না পারলে অস্তিত্ব বাঁচাতে জামায়াতকে বিএনপির কাতারেই দাঁড়াতে হবে। প্রকাশ্য বা গোপনে। আর জাতীয় পার্টি তো সরকারেরই ঘরের লোক; মুরব্বিরা বাধ্য না করলে আওয়ামী লীগকে ছাড়ার কোনো কারণ তাদের নেই। সুতরাং বামদের সঙ্গে বোঝাপড়া করাই থাকছে বিএনপির পয়লা কাজ।
বাংলাদেশের বাম দলগুলো নির্বাচনে জয়ী না হলেও রাজপথে লড়াইয়ের ইতিহাস তাদের কম না। ফুলবাড়ী কয়লাখনির বিরুদ্ধের আন্দোলন কিংবা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে তারা সেই প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রশ্নে তাদের বড় অংশটাই (সিপিবি-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি) আওয়ামী লীগের বৃত্তেই থাকতে ভালোবাসে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই তাদের ইতিহাস। সময়ে সময়ে যে অভিমান দেখা যায়, তা আদতে ‘আমরা আর আমাগো মামুদের’ পারিবারিক গোস্সার বেশি কিছু না। পড়লে তারা আওয়ামী দিকেই পড়ে। এটাই তাদের ঐতিহ্য। তা ছাড়া কোনো কোনো বাম তাত্ত্বিক যখন উন্নয়ন ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও অপরিহার্য মনে করছেন না, তখন তো তাঁদের সরকার পরিবর্তন কিংবা নির্বাচনী ব্যবস্থার রদবদলের গরজ বেশি হওয়ার কথা না। এ এমন এক চেতনা যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে রক্ষণশীলদের মাখামাখি তাঁরা দেখেও দেখবেন না বলে ঠিক করে রেখেছেন। সুতরাং সিপিবি-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টির বাম জোটের দিক থেকে বিএনপির কোনো আশা নেই। আবার ছোট বাম দলগুলোর কাছে কী পাবে বিএনপি, যা তার নিজের ঘরে নেই?
বামেরা ষাট দশক থেকেই মধ্যবিত্তের মধ্য আওয়ামী লীগের বৈধতা জুগিয়ে গেছে। বামেরা যে জোটে থাকে, সেই জোট অন্তত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সুশীল—এমন প্রচার সমাজে আছে। বামদের সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগ ষাটের দশক থেকে আশির দশক অবধি মূলধারার দাবিদার থেকেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বামদের অপর একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে থাকায় বিএনপিও নিজেদের বিকল্প মূল ধারা বলে দেখাতে পেরেছিল। সুতরাং ভোট নয়, টাকা নয়, পেশিশক্তি নয়, মধ্যবিত্তের মধ্যে নৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্যই বামদের দরকার বিএনপির। বর্তমান সময়ে বিএনপিকে রাজনীতির মূল ধারা হয়ে উঠতে হলে বাম ও মধ্যবাম দলগুলোকে লাগবেই।
আরেকটা মারাত্মক সংকটও বিএনপির রয়েছে। বিএনপির প্রধান নেতা খালেদা জিয়া একরকম অন্তরীণ আছেন। দ্বিতীয় নেতা তারেক জিয়াও দণ্ডিত আসামি অবস্থায় বিদেশে। মির্জা ফখরুল সাহেব সভা-সমিতিকে যতটা তীক্ষ্ণ; রাজপথে দাঁড়ানোয় কিংবা (ধরা যাক) প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার জোশ জাগানোয় ততটাই কমজোরি। এদিক থেকে বিএনপির অবস্থা পঞ্চাশ দশকের আওয়ামী লীগের মতো।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির যে বিন্যাস, তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠের খেলাটা বিএনপিকে একাই খেলতে হবে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা হেফাজতে ইসলাম ছাড়া আর কারও সাহায্য তাদের জয়ী করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াত বিষয়ে বিএনপির অন্য মিত্রদের আপত্তি আছে। গণসংহতি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিরও শক্ত বিরোধিতা আছে এ ব্যাপারে। এ জন্য তাঁরা আনুষ্ঠানিক জোটের বদলে আপাতত যুগপৎ আন্দোলনের কথাই বলেছেন।
আওয়ামী লীগ তখন ছিল উঠতি মধ্যবিত্তের দল। তাদের লড়াই ছিল মুসলিম লীগের পাঞ্জাবি ও দেশীয় অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন মধ্যবিত্তের তরুণ নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে দরবার করার জন্য তাঁর দরকার হয়েছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বর্ষীয়ান নেতাকে। দেশের পুরোনো রাজনীতিবিদদের সামলাতে ভরসা করতে হয়েছিল শেরেবাংলা ফজলুল হকের ওপর। আর রাজপথ গরম করতে ছিলেন মাওলানা ভাসানী। এমনটাই চলেছে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু যেই মুহূর্তে তরুণ আওয়ামী নেতৃত্ব নিজেদের কবজির জোর টের পেল, উঠতি মধ্যবিত্ত যখন থেকে জনগণের আস্থা অর্জনে আত্মবিশ্বাসী হলো, তখন থেকেই হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানির আর দরকার হলো না। বিএনপির যে সাংগঠনিক দশা এবং জনগণকে ডাক দেওয়ার ব্যাপারে তাদের যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, তা মেটাতে তাদেরও বর্ষীয়ান নাগরিক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন কিংবা রেজা কিবরিয়া অথবা আরও তরুণতর জোনায়েদ সাকি বা সাইফুল হকদের মতো মানুষকে লাগবে। নিজের বোঝা টানতে এখন তাঁদের দশের লাঠি বানাতে হবে। আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক করতেও বহু পক্ষের মদদ তাঁদের চাই। বিএনপি ছিল উঠতি মধ্যবিত্তের দল, আওয়ামী লীগ ছিল কৃষক আর শহুরে মধ্যবিত্তের দল। উঠতি মধ্যবিত্তের মানসিকতায় মুরব্বি ধরার ব্যাপার থাকে। বিএনপির এখন মুরব্বিও লাগছে, নৈতিক সার্টিফিকেটও লাগছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির যে বিন্যাস, তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠের খেলাটা বিএনপিকে একাই খেলতে হবে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা হেফাজতে ইসলাম ছাড়া আর কারও সাহায্য তাদের জয়ী করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াত বিষয়ে বিএনপির অন্য মিত্রদের আপত্তি আছে। গণসংহতি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিরও শক্ত বিরোধিতা আছে এ ব্যাপারে। এ জন্য তাঁরা আনুষ্ঠানিক জোটের বদলে আপাতত যুগপৎ আন্দোলনের কথাই বলেছেন। অন্যদিকে হেফাজত ইসলাম সুবিধা ও সাহসের দোলাচল এখনো কাটিয়ে ওঠেনি। তারা কী করবে, তা কেবল ভেতরের মহলই জানেন।
কিন্তু দিনের শেষে প্রশ্ন একটা থাকছেই। বারবার বিএনপির ঘর পুড়েছে মিত্রদের হঠকারিতা কিংবা প্রতারণার জন্য। ২০০১-২০০৬ দেখুন, ২০০৬-২০০৮ দেখুন। ৫ শতাংশ ভোটের লোভে তারা এর দ্বিগুণ মানুষের সমর্থন হারিয়েছিল। ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন, আবার ২০১৮-তে যেনতেনভাবে অংশগ্রহণের পেছনেও দলের ভেতরের লোক এবং বাইরের মিত্রদের ইন্ধন ছিল। এসব থেকে লাভের বদলে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। সমালোচকেরা বলে থাকেন, অনেক ক্ষেত্র বিএনপি না বুঝে নিজে অথবা মিত্রদের পরামর্শে সরকারের পাতা ফাঁদেই পা দিয়েছে। সুতরাং মিত্র তৈরি করা ভালো, জোট গঠন করাও অস্তিত্বের প্রয়োজন। তবে জোটের মধ্যে যাতে ট্রয়ের ঘোড়ারা ঢুকে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখাটাও জরুরি। বিএনপি যে একা তা বুঝে নিলেই দোকা হওয়ার কৌশল কাজে দেবে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক এবং প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]