বছর দুই পর রাজধানীতে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশ নিয়ে মনে হচ্ছিল বিএনপির নেতাদের চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতারাই বেশি ‘টেনশনে’ ছিলেন। এই সমাবেশে কত মানুষ এসেছিল কিংবা খালেদা জিয়া নির্বাচন নিয়ে কী বলেছেন—এসব প্রসঙ্গের চেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে হঠাৎ ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে এবং শহরের ভেতরে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি।
রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে, তাদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা জানাবে, জনগণই ঠিক করবে কোনটি তারা গ্রহণ বা বর্জন করবে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো জনগণকে সেই সুযোগ সব সময় দিতে চায় না। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, ভাবে, তারাই দেশ ও জনগণের সেবা করার একমাত্র হকদার; অন্য কারও এখতিয়ার নেই। ২০০৫–০৬ সালে বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা–বিবৃতির সঙ্গে এখনকার আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তৃতা–বিবৃতির অদ্ভুত মিল।
মেয়াদের শেষে এসে আওয়ামী লীগের সামনে বিরোধী দল বিএনপি যতটা না চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে দলের লোকজন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে যেসব খবর বের হচ্ছে, তা ভয়ংকর। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ সংগঠনের কর্মী হত্যা, নিরীহ ছাত্র কিংবা সাধারণ মানুষ হত্যার খবর বহুবার ছাপা হয়েছে। আমরা ভুলতে পারি না ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ে দরিদ্র দিনমজুরের ছেলে আবু বকরের মৃত্যুর কথা। গত সাত বছরেও সেই হত্যার বিচার হয়নি। অনেক আশা নিয়ে বাবা-মা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। কিন্তু সেই সন্তান বাড়ি ফিরল লাশ হয়ে। আর ফরিদপুরের গরিব অটোরিকশাচালকের ছেলে হাফিজুর মোল্লাকে সলিমুল্লাহ হলে জীবন দিতে হলো ছাত্রলীগের মধ্যরাতের তালিম নিতে গিয়ে। তিনি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। তারপরও শীতের রাতে ছাত্রলীগের এক নেতা তাঁকে ‘সাংগঠনিক ক্লাসে’ হাজির হতে বাধ্য করেন।
এ রকম অনেক অনেক অঘটন ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়েরকে হত্যা করে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপ। প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে আরও ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন শিক্ষক, প্রক্টর। এমনকি তাঁরা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ কে এম নূর-উন-নবীকে ১৪ ঘণ্টা তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখতেও দ্বিধা করেননি। পরে পুলিশি প্রহরায় তিনি বাসায় ফিরেছেন। তাঁর ‘অপরাধ’, ছাত্রলীগের নেতাদের চাকরি দেননি।
২০ অক্টোবরের আরেকটি খবর: দলীয় কর্মী খুনের ঘটনায় বিলুপ্ত হলো সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী দলীয় কর্মী ওমর মিয়াদ (২২) হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। খুনি ও খুনের আসামি দুজনই ছাত্রলীগের।
কিন্তু আগের সব অপরাধকে পেছনে ফেলে দিয়েছে শরীয়তপুরে ছাত্রলীগ নেতা আরিফ হোসেনের কীর্তি (!)। ছয় নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছেন এবং সেসব দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, শরীয়তপুরে ছয় নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতা আরিফ হোসেনকে (২২) গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ভুক্তভোগী নারীদের আপত্তিকর ছবি এবং ওই সব ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় নারীনেত্রীরা। তাঁরা দ্রুত এটি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, যাঁরা ভুক্তভোগী নারীদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা দেখি আওয়ামী লীগের কোনো নেতার নামে কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে তাঁকে ধরে–বেঁধে জেলখানায় পাঠানো হয়। আর পুলিশ ছাত্রলীগের ধর্ষক নেতাকে খুঁজে পায় না।
আরিফ শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ভুক্তভোগী নারীদের একজন গত শনিবার আরিফের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে ভেদরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন। একই দিন আরিফকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। এ রকম একটি ঘটনায় বহিষ্কার করেই সংগঠনের দায়িত্ব শেষ! এই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কিংবা অাওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছে গিয়ে দুঃখপ্রকাশ করতে দেখা যায়নি। যেন এটি মামুলি ঘটনা।
জাতীয় মহিলা সংস্থার শরীয়তপুর শাখার চেয়ারম্যান রওশন আরা বেগম বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারীরা এখনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আরিফ তাঁদের সর্বনাশ করেছেন। এখন কিছু সুযোগসন্ধানী বিকৃত রুচির মানুষ তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ মুঠোফোনে ছড়াচ্ছে।’ আমাদের সমাজের মানুষগুলো কতটা নিচে নেমে গেছে।
রাজনীতিকেরা ক্ষমতার হিসাব–নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এই দুরারোগ্য ব্যাধি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে যে সামাজিক জাগরণ দরকার, সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এমনকি ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিরোধী দলও এসব বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
এখানেই ছাত্রলীগ নামধারীদের অপকর্মের শেষ নয়। বরগুনার পাথরঘাটা কলেজে অজ্ঞাত এক তরুণীকে ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রলীগের চার নেতা, কলেজ শাখার সভাপতি রুহি আনান দানিয়াল (২২), সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (২১), ২ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম রায়হান (১৯) ও উপজেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদ (১৮)। এখানেও বহিষ্কার করেই জেলা ছাত্রলীগ তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান বলেছেন, ধর্ষণ শেষে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও নেতিবাচক কাজের জন্য তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
পত্রিকার খবর হলো, গত ১০ আগস্ট পাথরঘাটা কলেজের পেছনে খাস পুকুর থেকে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তরুণীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। এ ঘটনায় পাথরঘাটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনান দানিয়ালসহ ছাত্রলীগের চার নেতাকে পুলিশ গত শনি ও রোববার আটক করে। এর আগে ওই কলেজের নৈশপ্রহরী জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করে পুলিশ। তাঁর দেওয়া জবানবন্দির জের ধরে এই চার নেতাকে আটক করা হয়।
শরীয়তপুর ও পাথরঘাটার ঘটনায় ছাত্রলীগের যে পাঁচ নেতা–কর্মীকে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব বহিষ্কার করলেন, তঁাদের অতীত সম্পর্কে কি তঁারা কিছুই জানতেন না? কীভাবে, কার মাধ্যেম তাঁরা ছাত্রলীগে এসেছেন, সেসবেরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তাঁরা কি আগে থেকেই খারাপ ছিলেন, না ছাত্রলীগে এসে কারও সান্নিধ্যে খারাপ হয়েছেন? বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ চরিত্রটির নাম ক্ষমতা।
আওয়ামী লীগের নেতারা, সরকারের মন্ত্রীরা বিএনপিকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলেন। তাদের গণতান্ত্রিক ও ‘মানুষ’ হওয়ার সবক দেন। কিন্তু তাঁরা যদি এই সবকের কাজটি ছাত্রলীগ থেকে শুরু করতেন, তাহলে হয়তো অনেক নারীর সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা পেত। ছাত্রলীগ নামের যে সংগঠনটি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী বলে দাবি করে, যে ছাত্রলীগ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তোলে, সেই সংগঠনে এ রকম দানব পয়দা হয় কীভাবে?
ছাত্রলীগের যেমন গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে, তেমনি গ্লানির মাত্রাও কম নয়। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে এই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মহসিন হলে খুন হয়েছিলেন সাত নেতা–কর্মী। সেই ঘটনার প্রধান হোতা শফিউল আলম প্রধান নিজেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘খুনি তুমি যেই হও, শাস্তি তোমায় পেতেই হবে’। প্রধান ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। হত্যার দায়ে তাঁর জেলও হয়েছিল। পরে জিয়াউর রহমান জেলখানা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেন।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যেমন ছাত্রদল ক্যাম্পাসের রাজা বনে যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগও নিজেকে সিংহ মনে করে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করার জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যেত না। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাবন্দী, তখন আওয়ামী লীগের নারী কর্মীরাই মাঠে ছিলেন, ছাত্রলীগ নয়। আর এখন হলে হলে নয়, ‘ঘরে ঘরে’ ছাত্রলীগ।
আমরা অবাক হয়ে দেখতে পাই, যখনই ছাত্রলীগের কেউ কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, নারীর সম্মানহানি করেন, তখনই ছাত্রলীগ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে; ব্যক্তির অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না ইত্যাদি। কিন্তু ব্যক্তি যখন সংগঠনের ছাতার নিচে বসে অপকর্ম করেন, সেই দায় কীভাবে তঁারা এড়াবেন? ছাত্রলীগের ছায়া না থাকলে এ রকম দুষ্কর্ম করার সাহসই হয়তো ওই ব্যক্তিদের হতো না।
তাই আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না থেকে ছাত্রলীগকে সামলান। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে দাবি করেন। কিন্তু তঁাদের কাজকর্মে তার কোনো ছাপ নেই। কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক দ্বিতীয় বই কারাগারের রোজনামচা বিতরণ করা হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। ছাত্রলীগের কর্মীরা বইটি পড়লে দেখতে পেতেন, সে সময়ের ছাত্রলীগের সঙ্গে আজকের ছাত্রলীগের কত ফারাক। সে সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীরাও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের হত্যা করেননি বা ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দেননি।
স্বাধীনতার আগে ছাত্রলীগ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তারা সাহসী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আজকের ছাত্রলীগ আরিফ-দানিয়াল-সাদ্দামের মতো ধর্ষক পয়দা করছে। এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।