বাসনার মরুতে কেঁদো না, ও আমার সময়
সব যুগই তার সময়ের বীরের জন্য অপেক্ষা করে। আমরাও করছিলাম। সিনেমার হিরো নয়, সত্যিকারের হিরোর। তিনি দেখাও দিলেন একদিন। হিরো আলম সেদিন হিরো হলেন। যেহেতু তিনি হিরো আলম, সেহেতু মিডিয়া তাঁকে হিরো আলম বানাল। তিনি হিরোদের মতো পোশাক পরেন, নায়িকাদের সঙ্গে সেলফি তোলেন, নিয়মিত খবর হন।
হিরো হওয়ার দুর্মর বাসনা ছাড়া তাঁর আর কোনো যোগ্যতার কথা কেউ জানি না। তিনি দরিদ্র ছিলেন, লেখাপড়া তেমন জানেন না। বলতে গেলে তাঁর কোনো গুণই নেই। তবু তিনি হিরো। এক ভদ্রলোকের নাম ভোলানাথ। তিনি বলতেন, আমার নাম শ্রী ভোলানাথ। ভোলানাথকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি নিজেই কেন নিজেকে শ্রী বলে সম্বোধন করেন? ভোলানাথের উত্তর, ‘ভাইরে, আমার জীবনের কোথাও কোনো শ্রী নেই, তাই নামের আগে শ্রী লাগায়ে রাখছি।’ হিরো আলমেরও জীবনের কোথাও কোনো বাহাদুরি নেই, কিন্তু নামে তিনি হিরো। হিরো আলম বীর হতে গিয়ে শেষমেশ সেলিব্রিটি হয়ে গেলেন।
যুগের বীর আমরা পেয়েছি কি না, জানি না, তবে এর মধ্যে যুগের একটা সত্য ফুটে ওঠে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের যুগে সবাই হিরো হতে চায়। সবাই চায় নিজেকে জীবনের থেকে বড় এবং সূর্যের চেয়ে ঝলমলে দেখাতে। জাতীয়তাবাদের যুগে আগে হিরো আসতেন যুদ্ধ জয় করে। যখন যুদ্ধ নেই, তখন অপরের জন্য জীবন দেওয়াকে বীরত্ব ভাবা হতো। ‘আমার জন্য’ কেউ বীর হয় না, বীর হয় ‘সকলের জন্য’ সাহসী ও মহৎ কিছু করার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তারকা বানানোর কারখানা যে মিডিয়া, তা যে-কাউকেই কিছুদিনের জন্য ‘হিরো’ বানিয়ে রাখতে পারে। আমরা এমন একসময়ে বাস করি, যেখানে বিখ্যাত হওয়া প্রশংসার ব্যাপার। এই স্বপ্নের তলায় আছে অনেক পণ্যের মধ্যে ‘আলাদা’ এক পণ্য হয়ে ঝলমল করার ইচ্ছা। এই ইচ্ছাই সেই কাঁচামাল, যাকে প্রসেস করে মিডিয়া ‘হিরো’ বানানোর কল চালু রাখে। পাবলিকও ক্ষণিকের তরে মাতে। আমরা সবাই এখন ক্ষণিকের সন্তান।
অতীতের বীরেরা চাইতেন ভালোবাসা, ভক্তি, ক্ষমতা। এখনকার বীরেরাও ওই তিনটি সুস্বাদু জিনিস চান। বিনিময় বাজার তাঁকে বিক্রি করে, জনতা তাদের ভাবমূর্তি ভক্ষণ করে। পণ্য বা বিনোদনের বাজারে বিক্রি হতে না পারলে এই হিরোদের অনেককেই বাপের হোটেলেই ভাত খেয়ে যেতে হতো। হয়ও, ক্যামেরাপাতের বাইরে।
তবে হিরো আলমরাই এখনকার প্রেরণা। কিছু না করে খ্যাতি চাওয়ার উসকানি। জীবন বাজি ধরে, মন-মগজ-ইচ্ছা খাটিয়ে কিছু করার ধাত নেই। লাইফ নেই, শুধু স্টাইল আছে। সেই স্টাইলও ধার করা। অথচ চিত্রনায়িকা কবরীর তাকানো, রাজ্জাকের হাসি, ববিতার কটাক্ষ কতই-না নিজস্ব। কতই-না নিজস্ব যেকোনো সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধার রণভঙ্গিমা।
চারপাশে প্রভাব ফেলার ইচ্ছা কোনো দোষের ব্যাপার না। কিন্তু প্রভাবের যোগ্যতা না বাড়িয়েই যদি প্রভাবশালী হওয়ার ইচ্ছাটা মালয় দ্বীপের সেই বোকা শিয়ালের মতো যে ‘লাগলে খিদে মুরগি এঁকে দেয়ালে/ আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে’। আপন মনের বাসনাপূর্তির সেই সুযোগ আছে বলেই বোকা শিয়ালদের প্রিয় জায়গা ফেসবুক ওয়াল। সেখানে অনেকেই আমরা শুধু বাসনার সেলফি তুলি আর তুলি। ওদিকে জীবন হতে থাকে মলিন। ইনস্ট্যান্ট নুডলের মতো ইনস্ট্যান্ট সুখ ও সফলতা চাইতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি জীবনের অনেকটাই। শিশু যা চায়, অস্থির হয়েই চায়। মুহূর্তের তাড়না, মুহূর্তের প্রয়োজন, মুহূর্তের উত্তেজনায় আমরা বড় সময়ের দম হারিয়ে হয়ে পড়ি মুহূর্তবাদী। ওদিকে চালাক শিয়ালেরা ঠিকই বাস্তব আঙিনায় সত্যিকারের মুরগি ধরে চলেছে। সফলতা মুহূর্তে বা মাসে আসে না, তা বড় সময়ে বড় পরিকল্পার কাজ।
যে ছেলেটি তৎক্ষণাৎ নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে বাবাকে হত্যা করেছিল, যে ছেলেটি প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে সিলেটের খাদিজাকে কুপিয়েছিল, অর্জনের সাধনা তাদের ছিল না। তাদের ছিল না অপেক্ষার আত্মবিশ্বাস, চেষ্টা করে যাওয়ার ধৈর্য। তারা সুখের বাটন টিপে জলদি সুখ না পেয়ে হতাশ, তারপর হতাশ থেকে মাদকাসক্ত এবং মাদকাসক্তি থেকে নির্জীব অকর্মা কিংবা সন্ত্রাসী হয়ে পড়ে। যারা দ্রুত বিত্ত বা ক্ষমতার মোহে সমাজবিরোধী পথে নামে, অথবা ধরা খেয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায়, তারা ওই মুহূর্তবাদী হিরোইজমের ভাইরাসে আক্রান্ত। মনমরা হতাশাবাদী আর অস্ত্র হাতে জঙ্গিবাদী, দুজনই চায় চমক বা ধমক দিয়ে লক্ষ্য পূরণ করতে। কিন্তু নিজের বা দুনিয়ার বদল এক দিনের কাজ নয়।
আমাদের অধিকাংশ যুবক কিন্তু অবাস্তব বাসনার জালে মাকড়সার মতো বসে নেই। পঞ্চগড়ে যে ছেলেটির অটোরিকশায় চড়ে মাইলের পর মাইল ঘুরেছি, তার কোনো স্মার্ট মোবাইল ছিল না। তার ভাবনা কীভাবে টাকা জমিয়ে আরও বেশি জমি ইজারা নিতে কৃষক বাবাকে সাহায্য করা যায়। যে চাকরিজীবী যুবক আরিফ উত্তরের প্রচণ্ড হিমের মধ্যে তাঁর মোটরবাইকে চড়িয়ে মানুষ ও ঘটনার দিকে আমাকে নিয়ে গেছেন, তাঁর কথা ছিল কম, কিন্তু নিজের জেলা নিয়ে উদ্বেগ ছিল বেশি। ফেসবুক, সেলফি, স্টাইল নিয়ে তাঁদের ভাবনা ছিল না। গত মাসে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের করতোয়া নদীর পাড়ে যে তরুণী মাকে শিশু কোলে নদীর চর থেকে উঠে আসতে দেখেছি, তিনি সকাল-সন্ধ্যায় দুটি স্কুলে পড়ান, বাচ্চা মানুষ করেন, স্বামীকে ঢাকার কলেজে পড়ানোর টাকা পাঠান। তিস্তা নদীতে মাছ না পাওয়া হতাশ জেলেদের দেখেছি নতুন জীবিকার খোঁজে চঞ্চল হতে। তাঁরা যে যে অবস্থানেই থাকুন, উন্নতি করায় বিশ্বাসী এবং সেটা এক দিনে নয়, দিনে দিনে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।
এমন বিরাট শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছি, যিনি মৃদুস্বরে নিজেকে চাপা রেখে অপরের ভেতরের গুণটা খোঁজেন। ৮১ বছর বয়সী বিশ্বখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনকে দেখেছি, যখন কিছুই করার নেই সুন্দরবনের অন্ধকার নদীতে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশের তারাগুলো বাংলাদেশের আকাশে কোথায় ফুটে আছে, তা খুঁজছেন। নষ্ট করার সময় এই সব মানুষের যেমন নেই, তেমনি সহজ আনন্দ ও প্রীতির জন্য একটু ধীরে চলতেও তাঁরা রাজি।
কিছু না করার হিরো আলম আমাদের মডেল নয়। আমাদের মডেল সামাজিক উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এগিয়ে থাকা তরুণেরা। আমাদের মডেল কৃষক-শ্রমিকের টিকে থাকার জেদ। আমাদের মডেল মধ্যবিত্তের সেসব যুবক-যুবতী, যাঁরা নিজের উপায় করেন এবং অপরের সহায় হন। আমাদের মডেল কক্সবাজারের সৈকতের নয় বছর বয়সী গানওয়ালা জাহিদ। দুঃখিনী মাকে সাহায্য করবে বলে পর্যটকদের কাছে গিয়ে বলে, ‘একটা গান শুনবেন, বাইয়া!’ দুঃখ তার গলাকে এবং মনকে আরও শাণিত করে। দুঃখ যদি তোমার থাকেই, তাকে বরং আরও ধারালো করো, বাসনার মরুভূমিতে কেঁদো না সময়। মরুর বালু তোমার সব অশ্রু শুষে নিয়েও সামান্য তৃণও জাগাতে পারবে না। কবি ও শিল্পী কফিল আহমেদের গানটা মনে রাখি : ‘কাঁদলে কিরে ধুলার পাহাড়ে...গঙ্গা বয়ে যাবে?’