বাপু, তোমরা আর নীতিকথা শোনাতে এসো না
আমরা যারা ‘অমুক এই কথা বলেছেন’, ‘তমুক এই কথা বলেছেন’ লিখে দিয়েই সাংবাদিকতার দায়িত্ব শেষ করি, তাদের চোখ খুলে দেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিকতাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। লাখ লাখ মার্কিন গোপন নথি ফাঁস করে তিনি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সরকারের মিষ্টি কথার ছলে তলেতলে কী যে চলে, তা আমাদের সামনে উন্মোচন করেন অ্যাসাঞ্জ। ক্ষমতাধর ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মুখোশও খুলে যায়।
উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়ে সব অপকর্মের ‘নাটের গুরু’ হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র। তারা নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ‘সোল এজেন্ট’ দাবি করে। কিন্তু উইকিলিকসের তথ্য ফাঁসের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা হয় ন্যাংটা রাজার মতো। সবার কাছে সব ফকফকা হয়ে যায়। বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর বিস্তর কুকর্ম ও নৃশংসতার খতিয়ান বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করে অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস। বিভিন্ন দেশ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কূটচালও প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে দেখা দেয় অস্বস্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সেকি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা!
শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন, আরও অনেক দেশের গোপন তথ্যও আমরা উইকিলিকসের কল্যাণে জানতে পারি। উইকিলিকসের এই ‘বিপ্লবী’ সাংবাদিকতায় ক্ষমতাধর দেশ, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ভীত হয়ে পড়ে। ভরা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ায় তারা বিব্রত হয়, ক্ষুব্ধ হয়।
রাষ্ট্রীয় কিংবা সরকারি অপকর্ম নতুন কিছু নয়। দেশে দেশে যুগে যুগে এই ‘কুকাজ’ হয়ে আসছে। রাষ্ট্র ও তার সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে তাদের ‘মিশন’ অব্যাহত রাখে। আমরা বোকা জনগণ ঘুণাক্ষরেও টের পাই না, আমাদের অজান্তে কী ভয়ংকর, কী গর্হিত, কী নোংরা সব জনবিরোধী কর্মকাণ্ডই না চলছে।
রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান—কেউই জনগণকে জানতে দিতে চায় না। তারা সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকে—জনগণ জেনে গেলেই বিপদ। ফুস করে বেলুন ফুটে যাবে। তাই বিদ্যমান কাঠামো, ক্ষমতা, অপকর্মের অন্ধকার জগৎ টিকিয়ে রাখতে গোপনে সব আয়োজন চলে।
তবে মাঝেমধ্যে বিধি বাম হয়। সেই সুবাদে গোপন তৎপরতার তথ্য অতীতে কালেভদ্রে ছিটেফোঁটা সংবাদমাধ্যমে এসেছে বটে; তবে উইকিলিকস সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। তারা যে পরিমাণ তথ্য ফাঁস করে, তা একদিকে যেমন বিপুল, অন্যদিকে বিস্ময়কর।
‘জানা গেছে’, ‘শোনা গেছে’ ধাঁচের সাংবাদিকতার মধ্যে নেই উইকিলিকস। তারা অকাট্য দলিল উপস্থাপনে বিশ্বাসী। অপকর্মের দায় এড়ানোর কোনো উপায় নেই। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উইকিলিকসের প্রবল প্রতাপের কথা মূলধারার গণমাধ্যমও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এ কারণে তারা নির্দ্বিধায় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্য লুফে নিয়ে দিনের পর দিন প্রতিবেদন করেছে।
অ্যাসাঞ্জই প্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁর নতুন ধারার সাংবাদিকতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারকে ঝাঁকুনি দিতে পেরেছেন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের হাঁটুতে কাঁপন ধরিয়েছেন। তাঁদের কাঠগড়ায় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। জবাবদিহির মুখে ফেলেছেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই অ্যাসাঞ্জ ‘হিরো’ বনে গেছেন। তিনি সাধারণের কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়েছেন। হয়ে উঠেছেন ‘এ যুগের চে’। একই সঙ্গে রথী-মহারথীদের গুমর ফাঁস করে তিনি শত্রুও বাড়িয়েছেন অনেক। তাঁকে ঘায়েল করতে উঠেপড়ে লেগে যায় শত্রুরা। তাঁকে আটকাতে চারদিকে জাল বিছানো হয়। অ্যাসাঞ্জকে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হয় লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে। সেখানে সাত সাতটি বছর কাটে তাঁর।
গত সপ্তাহে ইকুয়েডর অ্যাসাঞ্জের আশ্রয় বাতিল করে। তথ্য ফাঁসের জেরে ইকুয়েডরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লেনিন মরেনোর ক্ষোভ আছে অ্যাসাঞ্জের ওপর। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণ মওকুফ পাওয়ার জন্য মরেনো এই কাজ করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে আমরা দেখলাম, যুক্তরাজ্যের পুলিশ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে ঢুকে অ্যাসাঞ্জকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে বস্তার মতো করে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো।
অ্যাসাঞ্জ একজন সাংবাদিক। একজন প্রকাশক। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জানার অধিকারের জন্য তাঁর নিরন্তর লড়াই। অথচ, তাঁকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হলো, তাতে মনে হয়, তিনি একজন ভয়ংকর ‘ক্রিমিনাল’! অনেক কষ্টে তাঁকে ধরা গেছে, এবার জলদি জেলে ভরো!
ইকুয়েডর দূতাবাসে বসেও অ্যাসাঞ্জ সাংবাদিকতার কাজ করে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি ২০১৭ সালে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মরেনোর অজানা ছিল না। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, দূতাবাসকে গুপ্তচরবৃত্তির একটি কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন অ্যাসাঞ্জ। তাঁকে পুলিশের কাছে মরেনোর তুলে দেওয়ার পেছনে যে কোনো ‘কূট উদ্দেশ্য’ কাজ করেছে, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
অ্যাসাঞ্জ এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের ঝুঁকিতে আছেন। এই ঝুঁকির কথা তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা আগে থেকেই বারবার বলে এসেছেন। উইকিলিকসের প্রধানকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে দেশটি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই আশঙ্কাকে মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র তার পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিতে আইনকানুন, ন্যায়নীতি ভুলে সবকিছুই যে করতে পারে, তার বহু নজির আছে।
পশ্চিমারা কথায় কথায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জানার অধিকার, বাক্স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বুলি আওড়ান। অন্যদের অনবরত জ্ঞান দেন। এসব রক্ষায় মুরব্বি মুরব্বি ভাব নেন। অথচ আজ এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্যই অ্যাসাঞ্জকে বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো যতই ‘নীতিকথা’ বলুক না কেন, নিজেদের স্বার্থের বেলায় তাদের ‘ল্যাঞ্জা’ বেরিয়ে পড়ে। তখন নীতিনৈতিকতার ঠাঁই হয় সিন্দুকে। এই যেমন এখন, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে, অপকর্ম গোপন করতে, নির্বিঘ্নে জনবিরোধী কাজ চালিয়ে যেতে, তারা অ্যাসাঞ্জকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চায়।
তাদের এই ভণ্ডামি দেখে বলতে ইচ্ছে হয়, বাপু, আমাদের আর নীতিকথা শোনাতে এসো না। তোমাদের আমরা ঢের চিনি।
সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]