অনেকে দাবি করতে পারেন, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি নিরপেক্ষভাবে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। এক দিন আগে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষ হয়, তাতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ তিনটি মামলা করেছে। ১৫৩ জন আসামির নামে এবং তিন হাজার বেনামে।
অন্যদিকে বরিশাল সদর উপজেলার ইউএনওর বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ ও ইউএনও দুটি মামলা করেছেন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহসহ আওয়ামী লীগের ৭০–৮০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। বরিশালের সদর ইউএনও আরেকটি মামলা করেছেন, যার প্রধান আসামিও সিটি মেয়র।
প্রথম প্রশ্ন, এই সংঘর্ষ এড়ানো যেত কি না। কোথায় কারা এই সংঘাত উসকে দিয়েছেন? প্রথমে দেখা যাক ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে কী ঘটেছিল। বিএনপির ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর কমিটির নবনির্বাচিত নেতা–কর্মীরা মঙ্গলবার সেখানে গিয়েছিলেন তাঁদের নেতা জিয়ার কবর জিয়ারত করতে। পুলিশ বাধা দেয় পূর্বানুমতি না থাকার অজুহাতে।
সেই বাধা উপেক্ষা করে যখন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ১০–১২ জন কবরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন পুলিশ তাঁদের ওপর চড়াও হয় বলে বিএনপির অভিযোগ। পুলিশের পাল্টা অভিযোগ, বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর আক্রমণ করেছেন, গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। এক হাতে যেমন তালি বাজে না, দুই পক্ষেই আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
প্রশ্ন হলো, সংঘর্ষ এড়ানো যেত কি না। কর্মসূচিটি ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার কবর জিয়ারতের। সেখানে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী জড়ো হননি যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমিতসংখ্যক নেতা–কর্মীকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু পুলিশ অতি উৎসাহে হোক বা ওপরের হুকুমে, কবর জিয়ারতের কাজে বাধা দিল এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর তাঁদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। যেখানে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে, সেখানে রিমান্ডে নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে নতুন কী তথ্য বের করবে? সেই হুকুমের আসামিদের নাম? বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে থাকলে, গাড়ি ভাঙচুর করে থাকলে তার বিচার হওয়া উচিত। আর পুলিশ যদি শান্তিপূর্ণ কবর জিয়ারতের কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে সংঘর্ষে উসকে দিয়ে থাকে, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ইদানীং পুলিশ ও জনপ্রশাসনের অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে এমন সব কাজ করেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যা তাঁদের করা উচিত নয়। এক পুলিশ কর্মকর্তা তো দলীয় স্লোগান দিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করেছেন।
বরিশালের ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে রাতের আঁধারে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ জাহিদ ফারুকের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাকে কেন্দ্র করে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত আবদুল্লাহর অনুসারী নেতা-কর্মীরা পোস্টার–ব্যানার ছিঁড়ছিলেন। তাঁদের দাবি, নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
নগর পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। সদর উপজেলা ইউএনও মনিবুর রহমানেরও নয়। তিনি শুধু মেয়রের অনুসারীদের বলেছিলেন, ‘এটি সরকারি অফিস কম্পাউন্ড। ফলে রাতে এখানে পোস্টার না ছিঁড়ে আপনারা দিনের বেলায় আসুন। এখন আপনারা চলে যান।’ ইউএনওর এই বক্তব্যকে নগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভালোভাবে নেননি। এরপর দলবল নিয়ে সেখানে গিয়ে হামলা চালান বলে অভিযোগ ইউএনওর। তাঁরা ইউএনওকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এরপর ইউএনওর বাসভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
ইউএনওর দায়ের করা মামলায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭০ থেকে ৮০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জামাল বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলা করেন। মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) আলী আশরাফ মিঞা বলেন, বুধবার রাতে সরকারি বাসভবনে হামলা–ভাঙচুরের অভিযোগ এনে সদরের ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান বাদী হয়ে ২৮ জনের নামে ও অজ্ঞাতনামা ৭০-৮০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় হুকুমের আসামি (নির্দেশদাতা) করা হয়েছে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে।
ইউএনওর অভিযোগ, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষে লাগানো ব্যানার, ফেস্টুন রাতের আঁধারে ছিঁড়ে ফেলায় বাধা দিতে গেলে বুধবার রাতে তাঁর সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন আনসার সদস্য আহত হন। আওয়ামী লীগের দাবি, এ সময় তাদের অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শোকের মাসে পরিকল্পিতভাবে শহরকে অশান্ত করতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে।
বুধবার রাতের ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়।
আগে আমরা দেখতাম, প্রশাসন কিংবা পুলিশের ‘অবিচারের’ বিরুদ্ধে বিরোধী দল ধর্মঘট ডাকত। বাস-লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিত। ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, বিরোধী দল এখন লাইফ সাপোর্টে। তাই সরকারি দলই এসব ‘অবিচারের’ বিরুদ্ধে হরতাল-ধর্মঘট পালন করছে। এতে যে করোনাকালে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হলো, তা নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মাথাব্যথা নেই। বরিশালের এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের যত নেতা-কর্মী ইউএনওর বাসভবনে প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছেন, তাঁদের সিকি ভাগও করোনায় বিপন্ন মানুষের কাছে যাননি। এই হলো জনদরদি আওয়ামী লীগ।
বরিশালে বিরোধের কারণ আসলে ইউএনও নন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে তিনি শহরে কিছু পোস্টার ও ফেস্টুন টাঙিয়েছিলেন। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়রের তা পছন্দ হয়নি। এ কারণে নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে সেই পোস্টারগুলো রাতারাতি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। দুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর (প্রতিমন্ত্রী) বাসভবনের দরজায় যাঁরা লাথি মেরেছেন, ভিডিও ফুটেজে তাঁদের ছবিও দেখান। সিটি মেয়র যদি রাতের আঁধারে মন্ত্রীর পোস্টার–ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলেন, তাকে কী বলা যায়? এটি কি সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ নয়? বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মান নয়?
ইউএনও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তিনি সিটি মেয়র বা মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কর্মচারী নন যে তাঁদের জবরদস্তিও মেনে নিতে হবে। কয়েক বছর আগে আরেক ইউএনও সরাসরি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার অন্যায় আবদার না শোনায় তাঁর নামে অলীক মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে ওই ইউএনওকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এবারও ইউএনওর ঘটনা যে ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তিতে ফেলেছে, দলের সাধারণ সম্পাদকের কথায়ই তা প্রমাণিত। তিনি বলেছেন, অন্যায়করী যে–ই হোন না কেন, তাঁকে শাস্তি পেতে হবে।
অন্যায়কারীরা শাস্তি পান না বলেই বারবার একই রকম ঘটনা ঘটছে। সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কবর জিয়ারতে বাধা দিতে পারলেও মন্ত্রী বনাম মেয়র, আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের হানাহানি বন্ধ করতে পারে না। আইন নিজস্ব গতিতে চলার নমুনাই বটে।