বিষয়টি অবাক করার মতোই বৈকি! ভবনের ভেতরে গাছ নিয়ে অনেক গবেষণা কিংবা লেখালেখি হয়েছে। এমনকি বাস্তবিক অর্থে এমন অনেক নির্মাণের উদাহরণও দেখা যায় আমাদের দেশের স্থাপত্য ভাবনায়, যার শুধু বাইরের আবরণীতেই সবুজ গাছ শোভা পায়। তবে একবার ভেবে দেখুন তো—আপনি যে অফিসে বসে দিন-রাত কাজ করছেন, তার সভাকক্ষের ওপরে ঝুলে আছে লাল টমেটো, অভ্যর্থনাকক্ষে শোভা পাচ্ছে বাঁধাকপি কিংবা ফুলকপি কিংবা অফিসে ঢোকার সময় দেখতে পেলেন ধানগাছের বাতাসে দোল খাওয়ার দৃশ্য, সতেজ চিচিঙা আর করলা ঝুলে আছে আপনার টেবিলের পাশের দেয়ালেই। অবাক হওয়ার মতোই বিষয় নয় কি?
আর অবাক করা কাজটিই বাস্তবে করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘কোনো ডিজাইনারস’, যাদের নকশা এবং তত্ত্বাবধানে জাপানের রাজধানী টোকিওতে নির্মিত হয়েছে নয়তলাবিশিষ্ট ‘পাসোনা আরবান ফার্ম’ প্রতিষ্ঠানটি। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত জীবনের কাজের ফাঁকে কর্মীদের প্রকৃতির স্পর্শ দেওয়া, বিভিন্ন ঋতুতে বৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটানো। সেই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানকার কর্মীরা ভবনে উৎপন্ন সতেজ শাকসবজি দিয়েই তাঁদের প্রতিদিনকার সকাল কিংবা দুপুরের বেশির ভাগ খাবার সারেন, এমনকি অতিথিদেরও আপ্যায়ন করা হয় এসব দিয়ে।
৫০ বছরের পুরোনো প্রায় ১৯ হাজার ৯৭৪ বর্গমিটারের (৪৩ হাজার বর্গফুট) ভবনটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দুই শতাধিক প্রজাতির শাকসবজি আর ফুল-ফলের গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে, যা থেকে প্রতিদিন এই অফিসের কর্মীরা নির্ভেজাল খাদ্যের জোগান পাচ্ছেন। অফিসের সব কর্মীকেই বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটি নির্মাণে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিরলস কাজ করেছেন একদল অভিজ্ঞ কৃষিবিদ। অফিসের ভেতরে এই ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও আলো-বাতাস নিয়ন্ত্রণ করে। শক্তির অপচয় কমানোর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে আলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সাধারণের থেকে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ কম শক্তিসম্পন্ন। আর এর জন্য অফিসের সবাইকে বিশেষভাবে স্থাপত্য-কৃষি জ্ঞানের ওপর সমন্বয়িক অভিজ্ঞতা রাখতে হয়, পরিবেশ ঠিক রাখার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়, এমনকি সবাইকেই কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করতে হয়।
এখন তাঁরা কাজ করছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ভবনটিতে কর্মরত সবারই দিনের বেশির ভাগ খাদ্যের জোগান হচ্ছে, তেমনি এর কারণে কর্মীদের যাতায়াতের খরচ কমিয়ে যানবাহন ব্যবহার ও শক্তির অপচয় কমানো হয়েছে। ভবনটিতে যৌথভাবে মাটিবিহীন (হাইড্রোফোনিক) ও মাটিতে ফসল উৎপাদনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি–বিষয়ক পিএইচডি গবেষক সবুর তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ উপায়গুলো খুব সহজেই আমাদের দেশে ব্যবহার করা যেতে পারে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব কম খরচেই তা করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন মনমানসিকতার পরিবর্তন আর নিজস্ব কিছু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, আর এ ক্ষেত্রে হাইড্রোফোনিক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে আমাদের মাটির উর্বরতার কারণেও খুব কম সময়ে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারি। এবার চোখ ফেরানো যাক আমাদের দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ বড় বড় শহরের অফিস ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর দিকে। কম করে হলেও এসব জায়গায় বাণিজ্যিক ভবনের উচ্চতা ছয়তলার কম নয়। এগুলোর রয়েছে সুবিশাল ছাদ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা ও বিস্তর কাচ দিয়ে ঘেরা বহিঃআচ্ছাদন, যেখানে বেশির ভাগ স্থাপনার প্রায় ৬০ শতাংশের বেশিই আচ্ছাদিত, প্রায় ১০-১৫ শতাংশ মাটি বা সবুজ অংশ। অনেক ভবনে সবুজের পরিমাণ এর থেকেও কম, যে কারণে ভবনের ভেতরে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহের বড়ই অভাব। এমতাবস্থায় শহরের সবুজের পরিমাণও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। আমরা যদি স্বেচ্ছায় স্থপতি, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদের সাহায্য নিয়ে অন্তত নিজেদের প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ আরবান ফার্মিংয়ের কাজ শুরু করে দিতে পারি, তাহলে অচিরেই আমাদের বসবাসের অনুপযোগী শহরকেও পৃথিবীর বুকে সব থেকে স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসের উপযোগী সবুজ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
আমাদের স্থপতিরা যেকোনো নকশা প্রণয়নে প্রয়োজনবোধে কৃষিবিদের নিয়ে (যাঁরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ খাদ্য কিংবা সবুজ উৎপাদনে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ) টিম গঠন করতে পারেন। সেই সঙ্গে নতুন ও পুরোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে বর্তমানের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়ও বিশেষ একটি অনুচ্ছেদ সংযোগ করা যেতে পারে—এসব ক্ষেত্রে স্থাপনার কাঠামো, সময় ও ধরন হিসাব করে যেখানে অভ্যন্তরীণ ফ্লোর এরিয়া রেশিওতে কতটুকু কৃষি উৎপাদন কিংবা সবুজের সমারোহ সম্ভব, সেটি উল্লেখপূর্বক তার উপযোগিতা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করা না হয় এবং নির্মাণাধীন স্থাপনাতে সঠিক মনিটরিং থাকতে হবে।
শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বাসা কিংবা অফিসে সময় কাটাতে একপ্রকার বাধ্য হন। শরীর ও মনের ওপর এর প্রভাব তাঁদের কর্মক্ষমতা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। তা ছাড়া, বাণিজ্যিক ভবন ও অফিসগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। তাই আমরা যদি বাণিজ্যিক অফিস ভবনগুলোতে সাধারণ নিয়মে অথবা হাইড্রোফোনিক উপায়ে সবজি চাষ করতে পারি, সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হবে, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায়। আর এমন মনোভাব ও ইচ্ছাশক্তিই হয়তো বদলে দেবে আমাদের শহরগুলোকে দূষিত এবং অস্বাস্থ্যকর নগরীর দায়ভার থেকে।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]