৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এবার অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দরিদ্র মানুষ কষ্টে আছেন। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। (প্রথম আলো, ৯ জুন) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ১২২টি কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র, কর্মহীন বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী, স্বামী পরিত্যক্তা, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতিতে কারা নেবে তাঁদের দায়িত্ব! নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখা যায়, রাষ্ট্র কখনো তাঁদের দায়িত্ব নেয়নি। মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণে অধিকতর দায়িত্ব নিতে শুরু করে। তখনই বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার মতো কর্মসূচিগুলো চালু হয়। পরবর্তীকালের বাজেটগুলোতে এসব কর্মসূচির আওতা ও সুবিধার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং সমাজের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নতুন নতুন কর্মসূচি যোগ হতে থাকে। বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সালে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করে। বিগত বাজেটগুলোতে যেসব কল্যাণমুখী কর্মসূচি প্রতিফলিত হয়েছে, তার মধ্যে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি ছিল অন্যতম। বিশেষত চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা হয়েছে।
পরিশেষে সামষ্টিক অর্থনীতির জনক জে এম কেইন্স ও নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁরা দুজনেই প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন, ‘দরিদ্র মানুষের হাতে টাকা দাও, সেটা কাজের বিনিময়ে হোক আর সরাসরি অর্থদান হোক। গরিব মানুষ তাদের সমুদয় অর্থ কেনাকাটায় ব্যয় করে। ফলে সামগ্রিক চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধিই বস্তু সৃষ্টির বৃদ্ধি ঘটিয়ে জোগান বৃদ্ধি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে সচল রাখে।’ কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেটের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই বাজেটে প্রথমবারের মতো দেশের ১৫০টি উপজেলার সব বয়স্ক মানুষ, বিধবা নারী ও স্বামী পরিত্যক্তাকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০২১-২২ বাজেটে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছিল ১৮ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, প্রায় ৮ লাখ দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগী, প্রায় তিন লাখ ল্যাকটেটিং ভাতাভোগী মা । বাজেটে হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৯৫ হাজারে উন্নীত করা হয়েছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর এমন কোনো শ্রেণি নেই, যাদের নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হলো, হিজড়া ও প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দিলে করছাড়। বাজেটে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারের এ পদক্ষেপ প্রশংসনীয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেখানে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে সরকারকে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য সরকারকে আরও একটু কল্যাণমুখী হতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তি, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য জনপ্রতি মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা ৭৫০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করতে হবে। নয়তো আসন্ন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র আওতায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার গরিব পরিবার রয়েছে, যাদের ১০ টাকা কেজি চালের দর ১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব বাজেটে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দরিদ্র মানুষ কষ্টে আছেন। তারপরও তিনি গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ চাল ১০ টাকা থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ টাকা করলেন। বাজেট কখনো গরিব মানুষকে সরাসরি কষ্ট দিতে পারে না। এটা বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনকালীন ওয়াদা—গরিবেরা ১০ টাকা কেজি চাল পাবেন, সেটারও বরখেলাপ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় যে ৬২ লাখ ৫০ হাজার গরিব পরিবার রয়েছে, তাদের জন্য ১০ টাকা কেজি চালের দর না বাড়ানোই হবে যুক্তিসংগত।
২০২২-২৩ বাজেটের সবচেয়ে বড় সুখবর হলো বাজেটে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা, যেখানে প্রবীণরা শেষ বয়সে তীব্র অর্থকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেন, রোগাক্রান্ত ভগ্ন শরীর নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হয় মারাত্মক অর্থসংকটে, সেখানে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাই প্রবীণদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদব্যবস্থা। এদিকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কথা শুনে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সরকারকে যেখানে বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ জোগান দিতে হচ্ছে, সেখানে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা টেকসই হবে তো? এত অর্থ কোথা থেকে আসবে! শোনা যাচ্ছে, একটি দাতা সংস্থা সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে রাখা দরকার, দাতা সংস্থা শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে এবং দীর্ঘ মেয়াদে এ ঋণের বোঝা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। মাঝপথে এসে থেমে যায়। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো এত চমৎকার একটি ব্যবস্থা মাঝপথে এসে যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে, সেটাই সবার কাম্য।
সুতরাং সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি দাতানির্ভর না হয়ে সরকারের পূর্ণ রাজস্ব আয়নির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু পেনশন স্কিম চালুর জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে, বাংলাদেশকে ‘ধীরে চলো নীতিতে’ অগ্রসর হতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে প্রথমত, ক্রমান্বয়ে রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, সব শ্রেণির মানুষের জন্য স্কিমটি একসঙ্গে চালু না করে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধীরে ধীরে দীর্ঘ মেয়াদে একশ্রেণির মানুষকে এ স্কিমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এতে সময় লাগবে, কিন্তু টেকসই হবে। পৃথিবীর কোনো দেশই উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার আগে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি।
আমাদের ২০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) অনুযায়ী ২০৩০ সালে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত হব এবং ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হব। সেটাকে সামনে রেখে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি বাস্তবায়নে এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে অনগ্রসর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যেই সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং ২০৪১ সালে যেদিন আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব, সেদিন যেন একটি গোষ্ঠী বা একটি লোকও এ স্কিমের বাইরে না থাকে, পায় আজীবন আর্থিক নিরাপত্তা।
এ ছাড়া আরও একটি মহান কাজে হাত দিতে পারে সরকার, তা হলো বেকার ভাতা। প্রথম দিকে বিশেষ বিশেষ শ্রেণির জন্য বেকার ভাতা স্কিম চালু করে ধীরে ধীরে সব শ্রেণির বেকার মানুষের জন্য বেকার ভাতা স্কিম চালু করতে হবে। দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে যেখানে আমরা মাসিক ভাতা এক হাজার টাকা সুপারিশ করেছি, বেকারদের সমপরিমাণ ভাতা দেওয়া যেতে পারে।
পরিশেষে সামষ্টিক অর্থনীতির জনক জে এম কেইন্স ও নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁরা দুজনেই প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন, ‘দরিদ্র মানুষের হাতে টাকা দাও, সেটা কাজের বিনিময়ে হোক আর সরাসরি অর্থদান হোক। গরিব মানুষ তাদের সমুদয় অর্থ কেনাকাটায় ব্যয় করে। ফলে সামগ্রিক চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধিই বস্তু সৃষ্টির বৃদ্ধি ঘটিয়ে জোগান বৃদ্ধি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে সচল রাখে।’ কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেটের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ড. এ এফ এম মফিজুল ইসলাম, মহাসচিব, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ডায়ালগ ও উপাচার্য, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়