কথা ছিল আগুন যখন জ্বলছে, তখন যেকোনো মূল্যে আগুন নিভিয়ে ফেলা নিয়েই কথা হবে। কথা ছিল সেই আগুন যাতে আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেই পদক্ষেপ নিয়ে আলাপ হবে। সর্বোপরি কথা ছিল, আগুন নেভানোর দায় এবং ক্ষমতা যার হাতে, তার ওপরে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করার। তারপর আগুন নিভে গেলে, অন্য এলাকায় সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি শেষ হলে, আলাপ হবে আগুন কেন লেগেছিল এবং তা ভবিষ্যতে আর না লাগার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই আলাপ তোলা। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিল, আগুন লাগানোর কারণ কী আর কীভাবেই-বা তা ঠেকানো যেতে পারে।
দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় শুরু হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের নানা অংশে। যথেষ্ট আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছিল সেটি নিয়ে। হাতে গোনা দু-একজনকে বাদ দিলে সেই সময় রাষ্ট্রের ভয়ংকর প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে খুব কম মানুষই সরকারকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন। তাঁদের মধ্যে একশ্রেণি প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আড়াল করে সামনে নিয়ে আসছেন ভবিষ্যতে আগুন লাগা ঠেকানোর নানা নিদান। যাঁদের বক্তব্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে মোটামুটি এই কথাগুলো দিয়ে— ‘সরকারকে আমরা দায় দিতেই পারি, কিন্তু...’
‘কিন্তু’-এর পর সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছে, এর মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার প্রেসক্রিপশন। তাঁরা বলতে চাইছেন, বাঙালিত্ব দিয়েই সম্ভব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দূর করা। সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলাগুলো ঘটেছে, সেগুলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে ঘটেছে, এটি বিশ্বাস না করার পেছনে অনেক শক্ত যুক্তি রয়েছে। তবুও আমার এই কলামের আলোচনার স্বার্থে ধরে নিচ্ছি এগুলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কারণে ঘটেছে। তবে এটি মেনে নিতে আমার দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ হচ্ছে। তারপরও প্রশ্ন আসে, একটি পরিচয়বাদী সংকটকে কি আদৌ আরেকটি পরিচয়বাদ দিয়ে ঠেকানো যায়?
দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় শুরু হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের নানা অংশে। যথেষ্ট আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছিল সেটি নিয়ে। হাতে গোনা দু-একজনকে বাদ দিলে সেই সময় রাষ্ট্রের ভয়ংকর প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে খুব কম মানুষই সরকারকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন।
আইডেনটিটি (পরিচয়): ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার চোখে
মার্কিন রাজনীতি বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বৈশ্বিক আলোচনায় আসেন তাঁর ‘দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইটির কারণে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বড় ধরনের ভ্রান্তি রয়েছে। অনেকে মনে করেন ফুকুয়ামা বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর লিবারেল ডেমোক্রেসি একমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে টিকে থাকবে, যদিও এই ধারণা ভুল।
এটা ঠিক, ফুকুয়ামা মনে করেন, বিশ্বাসও করেন, লিবারেল ডেমোক্রেসিই মানুষের জন্য সবচেয়ে আদর্শ শাসনব্যবস্থা, মানুষকে এটাতেই শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হবে। কিন্তু নানা সময়ে তিনি এটিও খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে এই শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক রাষ্ট্রের স্খলন হবে, কিন্তু সেখানেই আবার ফিরে আসতে হবে।
সম্প্রতি তিনি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান হুমকি হিসেবে পরিচয়বাদী রাজনীতিকে (আইডেনটিটি পলিটিকস) চিহ্নিত করেছেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘আইডেন্টিটি: দ্য ডিমান্ড ফর ডিগনিটি অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব রিজেনমেন্ট’-এ ফুকুয়ামা দেখিয়েছেন কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাজনীতিতে আইডেন্টি পলিটিকস মাথাচাড়া দিচ্ছে এবং তার প্রভাবে উদার গণতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে।
ফুকুয়ামা এটা মেনে নেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তাঁর বিভিন্ন রকম পরিচয়ের ভিত্তিতে আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে। ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক শ্রেণি, জাতিগোষ্ঠী, লিঙ্গ, যৌন আচরণ—এ সবকিছুর ভিত্তিতেই পৃথিবীর সব মানুষেরই কোনো না কোনো রকম পরিচয় থাকে। অনেকেই একে খুব শক্তভাবে ধারণও করেন। সে কারণেই তাঁরা চান তাঁদের এই পরিচয়ের স্বীকৃতি সমাজ বা রাষ্ট্র তাঁকে দিক। একটি রাষ্ট্রে তাঁর অবস্থান সংখ্যাগত বা প্রভাবের দিক থেকে যতই ছোট হোক না কেন, তিনি তাঁর সেই মর্যাদা সবার কাছে চান। তা যখন তিনি পান না তখনই তাঁর মধ্যে একধরনের অসন্তোষ কাজ করে। হাল আমলের পরিচয়বাদী রাজনীতিবিদেরা সেই অসন্তোষকেই পুঁজি করেন, সেটিকে উসকে দেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ
সাম্প্রতিক সংকটের সময় বা পরে অনেকেই আমাদের ঠিকঠাক বাঙালি হতে বলেছেন। একজন খুবই আলোচিত সাহিত্যিক ও কলামিস্ট দীর্ঘদিন বিরতির পর এই ইস্যুতে আবার কলম ধরেছেন। তিনি কলাম শেষ করেছেন এই কথাগুলো বলে—
‘কাজেই এখন ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার আমাদের বাঙালি হওয়ার সময় এসেছে। একসময় বাঙালি হয়ে আমরা আমাদের ভাষাটিকে পেয়েছিলাম, তারপর আবার বাঙালি হয়ে দেশটিকে পেয়েছিলাম। এখন আবার বাঙালি হয়ে সেই দেশকে অসাম্প্রদায়িক করার সময় এসেছে।’
মানব সভ্যতা একধরনের জাতি বা গোষ্ঠী বা গোত্রভিত্তিক সমাজকে কেন্দ্র করেই বিবর্তিত হয়েছে। এরপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘রাষ্ট্র’। অতি দীর্ঘকাল এমন সমাজব্যবস্থায় বসবাস করার ফলে রাষ্ট্র বা জাতি বা গোষ্ঠী বা গোত্রের প্রতি মানুষের যে বোধ, সেটি অনেকটাই জেনেটিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার ওপরে নিজ নিজ রাষ্ট্র বা জাতি বা গোষ্ঠী বা গোত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, কর্তব্যে সাড়া দেওয়া, প্রয়োজনে জীবন দেওয়ার ন্যারেটিভ আমাদের সামনে ক্রমাগত নিয়ে আসা হয় শৈশব থেকে। ফলে যেকোনো সংকটে এই বোধ দিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করে কিংবা উসকে দিয়ে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব।
এ কারণেই পৃথিবীর বহু যুদ্ধে আমরা দেখেছি কোনো না কোনো ফর্মের পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও। যুদ্ধে জেতার জন্য জাতীয়তাবাদের যে ধারণাটি আমাদের কাজে লেগেছিল, সে ধারণাটি কি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাধীন দেশ গড়ার অনেক দীর্ঘতর এবং কঠিনতর সংগ্রামে সাহায্য করবে? নাকি সে লড়াইয়ের বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
বাঙালিত্ব দিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে চাওয়ার বিপদ
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, এ দেশে বসবাসকারী সব নাগরিকের জাতীয়তা ‘বাঙালি’। দেখে নেওয়া যাক সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদ— ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন’। আমাদের জাতীয়তার বিতর্ক সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশেও হয়েছিল। হয়েছে এরপরও। হওয়ার যৌক্তিকতা আছে বৈকি।
শুধু একটি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে, সেই ধারণার অসারতা নিয়ে খুবই শক্ত যুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাঙালির নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কোনগুলো, সেগুলো কি একেবারে কঠিনভাবে নির্ধারিত নাকি সেগুলো সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন রূপ নেয় এসবও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখে আলোচনার খাতিরে ধরে নেই সবাই বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্যিকারের ‘বাঙালি’ হয়ে উঠলে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাজনিত ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা যাবে।
যাঁরা এই প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই খেয়াল করছেন না কিংবা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন—এই পরিচয়ের কথা বলে তাঁরা এই রাষ্ট্রের অবাঙালি নাগরিকদের ‘অপর’ করে তুলছেন। পাহাড় এবং সমতল মিলিয়ে বাংলাদেশে ত্রিশের বেশি জাতিসত্তা বাস করে, বাস করে উর্দুভাষী মানুষ, চা-বাগানে আছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাভাষী মানুষ। এই বাঙালি পরিচয়বাদ তাঁদের মধ্যে কি নিরাপত্তাহীনতাজনিত ভীতি তৈরি করে না? ঠিক তেমন ভীতি, যেটা জেগেছিল দুই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের মনে যখন ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হচ্ছিল।
কেউ বলতে পারেন বাঙালি পরিচয় উসকে দেওয়ার মাধ্যমে যদি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সফল হওয়া যায়, তবে সেটি যেসংখ্যক মানুষকে এক্সক্লুড করে এই সংখ্যা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে যা হয় এর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু একটি আধুনিক রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে এমন মন্তব্য করা দূরেই থাকুক, মনের মধ্যেও কি লালন করা যায়? কোনো জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা যত ছোটই হোক না কেন, তাদের কি বাদ দেওয়া যায়?
পরিচয়বাদের ধরন/ব্যাপ্তি সতত বর্ধনশীল
পরিচয়বাদী কৌশল, হোক তা যুদ্ধ জয়ের জন্য বা রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার বা থাকার জন্য, কিংবা জাতির কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার চিকিৎসার জন্য, তখন একে উসকে দিতে থাকে একের পর এক নতুন পরিচয়। মানুষকে কোনোভাবেই একটি পরিচয়ের গণ্ডিতে আটকে ফেলা যায় না।
ধর্মীয় পরিচয়কে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া জাতি বা রাষ্ট্র দীর্ঘ সময় ঐক্য বজায় রেখে চলতে পারেনি। অচিরেই সেই ধর্মের মধ্যকার নানা ইন্টারপ্রিটেশনের ওপরে ভিত্তি করে নতুন নতুন পরিচয় তৈরি হয়। সেই পরিচয়ের ভিত্তিতে বীভৎস সব সংঘাতের উদাহরণ দেওয়া যায় ভূরি ভূরি। একই কথা সত্যি অন্য পরিচয়ের ক্ষেত্রেও।
বাঙালিত্ব চাপিয়ে দেওয়াও কি সাম্প্রদায়িকতা নয়?
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমরা ধরেই নিই এটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। এর কারণ, আমাদের দেশে এই আলোচনা খুব কমই হয় যে সাম্প্রদায়িকতা হতে পারে নানা রকম। একটু ভেবে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, সম্প্রদায়কে ভিত্তি করেই যখন সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়, তখন সেটা হতে পারে সব রকম সম্প্রদায়কে ভিত্তি করেই।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ধ্বংসাত্মক, কিন্তু নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা একেবারে ঝুঁকিহীন কিংবা কম বিপজ্জনক, এমনটি তো নয়। বরং পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে জাতিভিত্তিক পরিচয়বাদ বীভৎস সব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ধ্বংসাত্মক, কিন্তু নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা একেবারে ঝুঁকিহীন কিংবা কম বিপজ্জনক, এমনটি তো নয়। বরং পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে জাতিভিত্তিক পরিচয়বাদ বীভৎস সব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
জাতিগত সাম্প্রদায়িকতা, রুয়ান্ডায় মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে ঘটা বীভৎসতম জেনোসাইড ছিল রুয়ান্ডান জেনোসাইড। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার হুটু আর টুটসি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটা এই জেনোসাইডে মাত্র তিন মাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ১০ লাখের মতো মানুষ (মূলত টুটসিরা)। এই জাতিগোষ্ঠীর বিভাজন ধর্মীয় ছিল না, উভয় জাতিই ছিল কালো এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। কিন্তু তাঁরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে এই বীভৎসতা ঘটিয়েছে।
সংঘাতের আগে জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ ছিল হুটু আর তুলনায় টুটসিরা ছিল প্রায় বাকিটা। হুটুদের তুলনায় ভীষণ সংখ্যালঘু হলেও টুটসিরা ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। এটিই ছিল আসলে সমস্যার মূল কারণ, কিন্তু বীভৎসতার ন্যারেটিভ তৈরিতে সামনে আনা হয়েছিল জাতিসত্তার প্রশ্ন।
রুয়ান্ডায় এখনো তুলনামূলকভাবে বেঁটে, মোটা, মোটা নাকের হুটুদের অনেকেই একজন স্লিম, লম্বা নাগরিকের দিকে তাকালে প্রথমেই তাঁর নাক খেয়াল করে পুরো নিশ্চিত হতে চায় তাঁর টুটসি জাতিসত্তা সম্পর্কে। অন্যদিক থেকেও বিষয়টি সেরকমই। এটি স্বাভাবিক, সেই বীভৎস জেনোসাইডের স্মৃতি মাত্র সিকি শতাব্দীতে মুছে যাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু সেই বীভৎস গৃহযুদ্ধের পর জাতিসত্তা নিয়ে আলোচনা রুয়ান্ডায় একেবারে নিষিদ্ধ। কেউ কারও জাতিসত্তার পরিচয় দেওয়া, জিজ্ঞেস করা বেআইনি। ভয়ংকর মূল্য দিয়ে রাষ্ট্র অন্তত বুঝতে পেরেছে সংকটটা কোথায়।
আমি জানি এটুকু পড়ার পর কারও কারও হয়তো মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে জাতিগত সংখ্যালঘুরা তো আর রুয়ান্ডার টুটসিদের মতো সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর নন। তাহলে আর আমাদের সমস্যা কী?
জাতিতাত্ত্বিক পরিচয়বাদের ভিত্তিতে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, মনে আছে নিশ্চয়ই। তর্কের খাতিরে ধরেই নিই তাঁরা আর কখনো এমন কিছু করবে না বা করতে পারবে না। তবুও কি একটি সভ্য জাতি হিসেবে এই মানুষগুলোর ভেতরে এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করব আমরা?
একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া উচিত স্রেফ নাগরিকের রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক শুধু তাঁর নাগরিকত্বের পরিচয়ে রাষ্ট্রের সব অধিকার পাবেন, সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। সেখানে বিশেষ কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, যৌন অভ্যাস কিংবা আর কোনো পরিচয়কে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় করে তোলা ভয়ংকর অন্যায়; রাষ্ট্র সমান স্বীকৃতি দেবে সব পরিচয়কে।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক
[email protected]