বাগদাদির মৃত্যু যে প্রশ্নগুলো সামনে এনেছে
আইএসের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা আবু বকর আল–বাগদাদি সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বারিশা গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর হামলার সময়ে
আত্মঘাতী হয়েছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। খবর সত্য হলে তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সহিংস উগ্র সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সর্বোচ্চ নেতা এবং আধ্যাত্মিক গুরু দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হলেন।
আইএস যা একসময় ইরাক ও সিরিয়ার এক বিশাল এলাকাজুড়ে, বাগদাদির ভাষায়, খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সে সংগঠন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের হামলা চালিয়েছে এবং অসংখ্য একক সন্ত্রাসীকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়েছে, তার নেতার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে সংগত কারণেই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
বাগদাদির মৃত্যুর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রথমত, বাগদাদির মৃত্যুর অর্থ কি আইএসের চূড়ান্ত পতন? দ্বিতীয়ত, বাগদাদির মৃত্যু থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন? তৃতীয়ত, বাগদাদির বিরুদ্ধে অভিযানের সাফল্যের জন্য কুর্দিদের সহযোগিতার উল্লেখ ও তাদের ধন্যবাদ দেওয়া থেকে কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিরিয়া নীতি—কুর্দিদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণা—ভুল প্রমাণিত হলো?
যে অভিযানের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে আটক হওয়া বা তাদের হাতে মৃত্যুবরণের চেয়ে আত্মঘাতী হওয়াকে বেছে নিয়েছেন বাগদাদি, তার সত্যতা বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ, অতীতে অনেকবারই বাগদাদির মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে রাশিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, বাগদাদি মারা গেছেন। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস পরের মাসে আবার তাঁর মৃত্যুর কথা বলেছিল। কিন্তু এসব খবর মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
এ ধরনের খবরের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, ২০১৪ সালে ‘খেলাফত’ ঘোষণার পর থেকে তাঁকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গত বছরের আগস্ট
মাসে বাগদাদির একটি অডিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে আইএসের সদস্য এবং সমর্থকদের প্রতি টিকে থাকার আহ্বান জানানো হয়। এর পরে এই বছরের এপ্রিল মাসে তাঁর একটি ভিডিও প্রচারিত হয়, যেখানে তিনি এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন।
অতীতের এসব ঘটনার পাশাপাশি সিরিয়ার স্থানীয় সময় রোববারের এ অভিযান নিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, ইদলিব এলাকায় এ ধরনের কোনো হামলাই হয়নি। এ ধরনের বক্তব্যের কারণে এখন অনেকেই হয়তো রাশিয়ার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাবেন যে এটি মার্কিনি প্রচারণামাত্র। তবে ইতিমধ্যেই বারিশা গ্রামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের যেসব সংবাদদাতা উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা হামলার প্রমাণ দিচ্ছেন, বাগদাদি মারা গেছেন তার প্রমাণ দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে আইএসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার। সেটি অচিরেই আসবে তা নয়, বিশেষত তার উত্তরসূরি নির্বাচন না করা পর্যন্ত তা পাওয়া যাবে না। তবে এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ কোনো সূত্র মার্কিন দাবিকে নাকচ করেনি বলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে বাগদাদির মৃত্যুসংবাদ সঠিক।
সেই বিবেচনা বহাল রেখেই প্রশ্ন উঠছে, এতে আইএসের চূড়ান্ত পতন ঘটল কি না। বাগদাদির মৃত্যুর প্রতীকী মূল্য অবশ্যই আছে। যেকোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা, বিশেষ করে এ মাপের নেতার মৃত্যু এবং তা একটি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটার কারণে তার প্রভাব সংগঠনের ওপরে পড়বে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার, গত দুই বছরে, বিশেষ করে এ বছরের মার্চ মাসে সিরিয়ায় আইএসের শেষ ঘাঁটি বাঘুজের পতনের পর বাগদাদি কার্যত পলায়নপর অবস্থায় ছিলেন এবং দৈনন্দিনভাবে নেতৃত্ব দিতেন না। ফলে অন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্ষেত্রে যেমন ঠিক, সেই একইভাবে এ মৃত্যু আইএসের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের জন্য একবারে ধ্বংসসাধনের মতো বিপর্যয় ডেকে আনবে মনে করার কারণ নেই।
তদুপরি আল-কায়েদা বা আইএস কেবল সাংগঠনিক কাঠামো নয়, এগুলো আদর্শে পরিণত হয়েছে; সেই আদর্শের পরাজয় এখনো হয়নি (দেখুন, ‘আইএসের আদর্শিক পরাজয় এখনো ঘটেনি’, প্রথম আলো, ২ জুলাই ২০১৯)। ফলে এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা মার্কিন প্রশাসন সাফল্য দাবি করলেও তারা ভালো করেই জানে যে আইএসের আদর্শের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবেই তাদের লড়তে হবে এ কারণে যে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফগানিস্তানে আইএসের প্রভাব বাড়ছে এবং আইএসের মতো সংগঠন যেসব কারণে বেড়ে ওঠে, তার মোকাবিলা না করে এ নিয়ে স্বস্তি বোধ করার কারণে নেই। তদুপরি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির যে একটা ভূমিকা আছে, সেটা বিবেচনায় না নিলে ঘুরেফিরে আবার আইএসের উত্থান ঘটবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এ অভিযান এবং বাগদাদির মৃত্যু থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে লাভবান হবেন কি না। ২০১১ সালে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ঘিরে এ প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা হালে পানি পায়নি। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে, কেননা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত ২০১৭ সাল থেকে চললেও এবং ম্যুলারের প্রতিবেদনে বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধাদানের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হলেও ইউক্রেন নিয়ে এখন প্রতিনিধি পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবেই ইমপিচমেন্টের তদন্ত শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত যাঁদের ডেকে নিয়ে শুনানি বা প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে যা জানা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগনামা তৈরি করা কঠিন হবে না। আইন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং নৈতিক কারণেই ডেমোক্র্যাটরা ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করেছে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে এটি তাদের জন্য আগামী নির্বাচনে বিপদ তৈরি করতে পারে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প চাইবেন এবং ট্রাম্পের আচরণে ইতিমধ্যে সুস্পষ্ট যে তিনি একে তাঁর রাজনৈতিক পুঁজি করতে চাইবেন। এ ধরনের জাতীয় নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট অভিযানের বিষয়ে স্পিকারসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের জানানো হয়। ট্রাম্প সেটা করেননি, বরং সংবাদ সম্মেলনে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট নেতাদের জানালে তা ফাঁস হয়ে যেত। এ নিয়ে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি অভিযোগ করে বলেছেন, আক্রমণের আগে রাশিয়াকে জানানো হয়েছে, কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের জানানো হয়নি। কেবল তা–ই নয়, গোয়েন্দাদের কাজের প্রশংসা করার সময় ট্রাম্প তাঁদের ওপরে তাঁর সম্পর্কে তদন্তের বিষয়ে ইঙ্গিত করে ঝাল ঝাড়তে কুণ্ঠিত হননি।
এগুলো অবশ্যই দলীয়ভাবে বিবেচনার লক্ষণ। এ অভিযানের সাফল্যের কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প দাবি করতে পারেন, কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযানের পরে ট্রাম্প ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর টুইট করেছিলেন, ‘বিন লাদেনকে হত্যা করার জন্য ওবামাকে অভিনন্দন জানানো বন্ধ করুন। নেভি সিলরা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে।’ তদুপরি স্মরণ করা দরকার যে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের গ্রীষ্মকালে আইএস–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে; এরপরে এ অভিযান অব্যাহত থেকেছে ওবামা প্রশাসনের পুরো সময় (বিস্তারিত দেখুন, পিটার বার্গেন, ‘ট্রাম্প ডিজার্ভস টু টেক এ ভিক্টরি ল্যাপ,’ সিএনএন ওয়েবসাইট, ২৭ অক্টোবর ২০১৯)। কিন্তু ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকেরা এসব বিষয়ে ধর্তব্য নেবেন না। ফলে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া যদি কাউকে খানিকটা বিব্রত করেও থাকে, এখন এ নিয়ে তাঁর আর কোনো দোদুল্যমানতা থাকবে না।
রিপাবলিকান দলের বাইরের সাধারণ মানুষের মধ্যে সাময়িকভাবে এ অভিযান ট্রাম্পের অনুকূলে প্রভাব ফেলবে, কিন্তু তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ভর করবে ডেমোক্র্যাটরা দ্রুত আলোচনা আবার ইমপিচমেন্ট এবং ইউক্রেন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ যে আইনানুগভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, সেটা দেখাতে পারছেন কি না।
রোববার সকালে ট্রাম্প তাঁর সংবাদ সম্মেলনে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন সবচেয়ে আগে। সেটা সবার কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছে, কেননা এ কথা কমবেশি সবাই জানে যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এখনো সে ধরনের হস্তক্ষেপের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এতে ট্রাম্প দেখাতে চেয়েছেন যে ডেমোক্র্যাট এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যা–ই বলুক, রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনে। এ বক্তব্যের সময় তিনি এই কুর্দিদের সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন এবং তাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত এ অভিযানের পেছনের ঘটনা যতটা জানা গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এ অভিযানের প্রস্তুতি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকালে। ফলে প্রশ্ন উঠছে যে মার্কিন সৈন্যরা সিরিয়ায় উপস্থিত না থাকলে যে ‘হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের’ কারণে এ অভিযান চালানো সম্ভব হয়েছে, সেটা সম্ভব হতো কি না, একই সঙ্গে কুর্দিরা সহযোগিতা না করলে এ অভিযান কি সম্ভব হতো? শুধু তা–ই নয়, মার্কিনদের উপস্থিতি প্রত্যাহারের কারণে কুর্দিদের তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো ছেড়ে সরে যেতে হয়েছে, ফলে কয়েক শ আইএস যোদ্ধা এখন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন বাগদাদির মৃত্যুর পরে তারা আরও বেশি করে সংগঠিত হতে চাইবে। সেখানে মার্কিন অনুপস্থিতি এবং কুর্দি সৈন্যদের সরে যাওয়ার কারণে আইএসে পুনর্গঠন সহজতর হবে। এ অবস্থা প্রমাণ করছে যে সিরিয়া বিষয়ে ট্রাম্পের নীতি আসলে না ওই এলাকার নিরাপত্তার জন্য, না যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হয়েছে। আবু বকর আল–বাগদাদিকে হত্যার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন কৃতিত্ব দাবি করলে তাঁকে এসব প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর