অনেকটা চমক দেখিয়েই বেসরকারিভাবে বাইডেনের জয় ঘোষিত হয়েছে। ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বাইডেনের সম্ভাব্য এই বিজয়ে বিশ্বজুড়ে আনন্দিত মার্কিনপন্থীরা। তবে এই আনন্দ আঙ্কারাকে আতঙ্কিত করেছে। আঙ্কারা বাইডেনের এই বিজয়কে ওবামা পরিষদ এবং মার্কিন ক্ষমতাবৃত্তের বিজয় হিসেবে দেখছে, সাধারণ মানুষের নয়। ৭ বছর ধরে আঙ্কারা ওবামা এবং মার্কিন ক্ষমতাবৃত্তের সঙ্গে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই করে গেছে। তাই প্রেসিডেন্ট পদে বাইডেনের আসার অর্থই হলো নতুন করে আবার সংঘর্ষপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যাওয়া, অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে পড়া।
ওয়াশিংটন এবং আঙ্কারার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সংকটের অন্ত নেই। সাম্প্রতিক সময়ের অন্তহীন এই সংকট শুরু ওবামা আমলের শেষের দিকে যখন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বেপরোয়া গতি পেয়েছিল। এই শুরুর আর শেষ হয়নি। ট্রাম্পের জমানায় এই সংকটগুলো ট্রাম্প এবং এরদোয়ানের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের দরুন বৃহৎ অর্থে নির্বিষ ছিল। কিন্তু বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এই ঘুমন্ত সমস্যা জেগে উঠেছে, যা বড় ধরনের সংঘর্ষের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
দ্বিপক্ষীয় এই সংকটের প্রধান বিষয় হলো সিরিয়ায় আঙ্কারার বিপক্ষে পিকেকের প্রতি মার্কিন সমর্থন এবং আঙ্কারার রাশিয়ার তৈরি এস ৪০০ ব্যবহারের জন্য পরীক্ষা করা। একই সঙ্গে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান প্রকল্প, লিবিয়া, ভূমধ্যসাগরের সীমানা নিয়ে বিবাদ, খাসোগি হত্যাকাণ্ড, হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সাম্প্রতিক সময়ের আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ তো রয়েছেই।
চার দশক ধরে বাইডেন ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের অংশীদার। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে ওয়াশিংটনের এই ক্ষমতাবৃত্তের প্রধান লক্ষ্য সিরিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে পিকেকের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্র গঠন করা। যার মাধ্যমে যুগপৎভাবে ইরান এবং তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মার্কিন স্বার্থ নিশ্চিত করা হবে। শুরু থেকেই প্রায় এক হাজার কিলোমিটারের তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে মার্কিনদের প্রকল্পিত এই রাষ্ট্র প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে আঙ্কারা এবং এই রাষ্ট্র গঠন ঠেকাতে আঙ্কারা সিরিয়ায় ছোট–বড় ৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং মার্কিন মদদপুষ্ট পিকেকের সৈন্যদের তুরস্কের সীমানা থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে চলে যেতে বাধ্য করেছে। মার্কিন প্রশাসন এই অভিযান মেনে নেয়নি। তাই ডেমোক্র্যাটদের মাধ্যমে বারবার আঙ্কারার ওপর অবরোধ দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ট্রাম্পের একক প্রচেষ্টা ও সমর্থনে এই অবরোধ আরোপ সম্ভব হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাচক্রে বাইডেনের ফেরার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পাশাপাশি সিরিয়ায় সম্মুখ সংঘর্ষের যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ভূমধ্যসাগরের সীমানা নির্ধারণ এবং লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফরাসিদের নেতৃত্বে ইউরোপীয়রা আঙ্কারার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি যুদ্ধাবস্থাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ন্যাটো এবং ম্যার্কেলের হস্তক্ষেপে উভয় পক্ষই আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। কিন্তু ঠিক মার্কিন নির্বাচনের আগমুহূর্তে রাশিয়ার তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০–এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার আঙ্কারা-ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আবার শীতল করে। অতীতে এ ধরনের সংকটে আঙ্কারার ওপর অবরোধ আরোপের প্রস্তাব করা হলেও ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ভেটোতে তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাইডেন এবং ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্ট এস-৪০০, ভূমধ্যসাগর এবং লিবিয়া নিয়ে সরাসরি ইউরোপীয়দের পক্ষ নিয়েছে এবং অবরোধ আরোপের কথা বলছে। তাই এই সব ফ্রন্টে ইউরোপীয়দের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিনদের মোকাবিলা করা তুরস্কের পক্ষে সম্ভব হবে না।
অসম্ভবকেই সম্ভব করার জন্য মাঠে নেমেছে আঙ্কারা। যে অসম্ভবের মধ্যে নিহিত রয়েছে বর্তমান তুরস্কের রাজনৈতিক অখণ্ডতা এবং এরদোয়ানের রাজনৈতিক জীবন। আঙ্কারা অবগত রয়েছে যে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে পিকেকে রাষ্ট্র গঠন করতে পারলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং তুরস্কের ভাঙন ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। আবার লিবিয়ায় ও ভূমধ্যসাগরে যথাক্রমে ফরাসি এবং গ্রিকদের ছাড় দিলে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। তাই তুরস্কের অখণ্ডতা এবং নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে মরিয়া এরদোয়ান। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এরদোয়ানকে ওবামার আমলে যতটা ধৈর্যশীল দেখেছে ওয়াশিংটন, এবার ততটাই বেপরোয়া দেখতে পারে। একই সঙ্গে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর সৌদি বলয়ের বিপরীতে আঙ্কারা-দোহা বলয়ের ভবিষ্যৎ নির্ভয় করছে। এরদোয়ানবিহীন মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
তবে এই দুর্দিনে আঙ্কারার জন্য বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার দুয়ার খোলা থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, ভঙ্গুর অর্থনীতি, করোনা মহামারি এবং বর্ণবাদে আক্রান্ত মার্কিন সমাজ গোছাতে বাইডেন সময় নেবেন। তাই বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে শিগগিরই বড় পরিবর্তন আসছে না। দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সালের বাইডেনের দেখা আঙ্কারা আর আজকের আঙ্কারার মধ্যে বিশাল তফাত রয়েছে। নতুন আঙ্কারা লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর, সিরিয়া এবং ককেশাস অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘মজবুত’ অবস্থান তৈরি করেছে। নতুন নতুন অস্ত্র বিশেষ করে ট্যাংক এবং ড্রোন আবিষ্কার করে সমর রাজনীতিতে নিজেদের সুসংগঠিত করেছে। তাই বাইডেনের সম্ভাব্য হুমকিতে আঙ্কারার অবস্থানে বড় পরিবর্তন আসবে না বলেই মনে করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তৃতীয়ত, ন্যাটো সদস্য তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সিরিয়া, লিবিয়াসহ অনেক সংঘর্ষের পরিক্রমা নির্ধারণ করছে। তাই বাইডেন এবং মার্কিন প্রশাসন আঙ্কারাকে ভয়াবহ অবরোধ চাপিয়ে দিলে আঙ্কারা-মস্কো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর হতে পারে। যে গভীরতা ন্যাটোসহ মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকায় মার্কিন স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
তবে এই কথা নিশ্চিত বাইডেনের আমল আঙ্কারার জন্য সুখকর হবে না। বাইডেন-ওবামা গং ২০১৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। কয়েক মাস পূর্বে ফাঁস হওয়া এক ভিডিও ক্লিপে বাইডেনবিরোধী দলগুলো বিশেষ করে কুর্দিদের সমর্থন দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় বলে জানিয়েছে। তাই বর্তমান এই মারমুখী অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু মার্কিনদের বিপক্ষে এরদোয়ান কতটা প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারেন, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আগামীর মধ্যপ্রাচ্যে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে আঙ্কারার অবস্থান।
রাহুল আনজুম আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।