যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্দশাগ্রস্ত বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য নানা কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচিত হলে এক বছরের মধ্যে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন করার কথা তখন তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বক্তৃতায়ও একই প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন। একই মাসে তিনি প্রথমবারের মতো বিশ্বনেতাদের সামনে হাজির হন মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে। সেখানে তিনি গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। সেই সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্র দুর্ঘটনাক্রমে নাজিল হয়নি। একে আমাদের সুরক্ষা দিতে হবে, এর জন্য লড়াই করতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে, নবায়ন করতে হবে।’
বাইডেন তাঁর সেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে যাচ্ছেন আগামী ৯-১০ ডিসেম্বর। এ সময়ে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব গণতান্ত্রিক সম্মেলন। এটা এখন কারও জানাবোঝার বাইরে নেই যে দীর্ঘ সময় ধরে দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের ক্ষয় ঘটে চলেছে, অবনতি হচ্ছে মানবাধিকার পরিস্থিতির। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে থাকা দেশ—সবখানেই গণতন্ত্র চাপের মুখে পড়েছে। দেশের ভেতর ও বাইরে—দুই দিক থেকেই চাপ আসছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অনেক দিন ধরেই বলে যাচ্ছেন, সমতাভিত্তিক এবং টেকসই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে না পারায় দেশে দেশে এমন নেতাদের উত্থান ঘটেছে, যাঁরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নষ্ট করে ফেলছেন। দুর্বল রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, দুর্বল আইনের শাসন, উচ্চ বৈষম্য ও দুর্নীতি গণতন্ত্রের ক্ষয় ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে। এ সময়ে এমন অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার উত্থান ঘটেছে, যাঁরা নিজের দেশে ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজে ভূমিকা রাখছেন।
গত সোমবার প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল স্টেট অব ডেমোক্রেসি ২০২১’ শিরোনামের এক গবেষণা প্রতিবেদন। সুইডেনের স্টকহোমভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (আইডিইএ) এই গবেষণা জরিপের কাজ করেছে। সেই প্রতিবেদন বলছে, দুনিয়াজুড়ে বড়সংখ্যক দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলোও এই হুমকির মুখে পড়েছে। এর আগে কখনো এত বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে পড়তে দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে আগে কখনো এত বেশিসংখ্যক দেশে গণতন্ত্রের মানের এই অবনতি ঘটেনি। বিশ্বের জনসংখ্যার ৭০ ভাগ এখন এমন দেশে বাস করছে, যেখানে হয় গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকর নেই অথবা গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি তিনজন মানুষের একজন কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে বসবাস করছে।
গণতন্ত্রের এই মহা দুর্দশার কালে বাইডেনের এই সম্মেলনকে একটি সূচনা হিসেবে বিবেচনা করছে তাঁর প্রশাসন। এই সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় এক বছর পর পরবর্তী সম্মেলনটি হবে—এমন ঘোষণাও রয়েছে। এবারের সম্মেলনের আর এক মাস সময়ও নেই, কিন্তু এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খুব বেশি খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বাইডেন প্রশাসন বেশ গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে। যে কারণে সম্মেলনের অ্যাজেন্ডা কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ পর্যন্ত প্রকাশ পাওয়া কিছু সংবাদ ও প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায়, এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর অঙ্গীকার করবে। পরের সম্মেলনে দেশগুলো এসব অঙ্গীকার কতটুকু পালন করল, তার পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হবে। বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে ‘উৎসাহিত’ করার এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে। গত ২৫-৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মান ক্রমাগত নিচে নেমেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। আইডিইএর পর্যবেক্ষণ অনুয়ায়ী ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে ‘দৃশ্যমান অবনতি’ শুরু হয়। গণতন্ত্রের মান নামতে নামতে এখন যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, তাকে টেনে তুলে ধরতে অবশ্য সময় লাগারই কথা!
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার ও চাঙা করা নিশ্চয়ই বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের ঘোষিত উদ্দেশ্য। কিন্তু এর সঙ্গে চীনকে মোকাবিলার কৌশল যে জড়িয়ে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সম্মেলন বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে।
এই গণতন্ত্র সম্মেলনে কোন কোন দেশ বা নেতা যোগ দিচ্ছেন, সেটা এক বড় কৌতূহলের বিষয়। বাইডেন প্রশাসন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রিত দেশ বা নেতাদের কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনৈতিক জার্নাল পলিটিকো কোন কোন দেশ এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাচ্ছে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে ১০৮টি দেশের নাম রয়েছে। সেই তালিকা ধরে কিছু কিছু দেশ কেন আমন্ত্রণ পেয়েছে বা কিছু কিছু দেশ কেন আমন্ত্রণ পায়নি, তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে।
আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, পলিটিকো প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। সেই হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি, বাংলাদেশ বাইডেনের ডাকা গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাচ্ছে না। গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ কেন আমন্ত্রিত নয়? এর পেছনের যুক্তি বা ব্যাখ্যা কী? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে নারাজ। আবার আমন্ত্রিত ও অংশগ্রহণকারী দেশের তালিকা পর্যালোচনা করেও কোনো ইঙ্গিত পাওয়া কঠিন। পলিটিকোর তালিকা অনুযায়ী সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপ আমন্ত্রণ পেয়েছে। বাদ পড়েছে ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতি, নির্বাচন—এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা ও আপত্তি আছে। সেটা যদি বাদ পড়ার কারণ হয়ে থাকে, তবে সেই বিবেচনায় আরও অনেক দেশেরই বাদ পড়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউসের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী সার্কভুক্ত এই সাত দেশই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিবেচনায় ‘পার্টলি ফ্রি’ বা আংশিক স্বাধীন। অবস্থানের দিক থেকে দেখলে পাকিস্তান বাংলাদেশের নিচে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত ভারত যে মোদির শাসনামলে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে, তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। ফিলিপাইনের দুতার্তের কর্তৃত্ববাদী শাসন, সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। ফিলিপাইন আমন্ত্রণ পেল অথচ বাদ পড়েছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। আমন্ত্রিত দেশ পোল্যান্ড নিয়েও একই কথা খাটে। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো গণতন্ত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছে (হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া ও তুরস্ক), তার মধ্যে একটি হচ্ছে পোল্যান্ড। সার্বিয়া ও তুরস্ক বাদ পড়েছে, ডাক পেয়েছে স্লোভেনিয়া। আবার ফ্রিডম হাউসের দৃষ্টিতে ‘নট ফ্রি’ দেশ ইরাক রয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশের তালিকায়। বাদ পড়েছে মিসর।
বোঝা যাচ্ছে, শুধু গণতন্ত্রের মান খারাপ না ভালো, এই বিবেচনা থেকে বাইডেন প্রশাসন আমন্ত্রিত দেশের তালিকা ঠিক করেনি। এখানে সম্ভবত ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও রয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার পর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রথম বক্তৃতায় বাইডেন দাবি করেছেন, তাঁর মেয়াদকালে চীন ও রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী শক্তিকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র আবার বিশ্বনেতৃত্বে ফেরত আসবে। বাইডেনের এই গণতন্ত্র সম্মেলন কি তবে ‘বিশ্বনেতৃত্বে’ ফিরে আসার পথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম (নাকি দ্বিতীয়? অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত জোট ‘অকাস’ যদি প্রথম হয়) পদক্ষেপ? যদি তা-ই হয়, তবে বুঝতে হবে, যে দেশগুলো এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছে, সেই দেশগুলোকে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এগোতে চাইছে।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার ও চাঙা করা নিশ্চয়ই বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের ঘোষিত উদ্দেশ্য। কিন্তু এর সঙ্গে চীনকে মোকাবিলার কৌশল যে জড়িয়ে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সম্মেলন বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণকারী ১০৮টি দেশের একধরনের নেতৃত্বের ভূমিকায় আবির্ভূত হবে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই মেরুকরণে আমন্ত্রণের বাইরে থাকা দেশগুলোর গায়ে কী তকমা লাগবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ কেন আমন্ত্রণ পেল না—এই প্রশ্নের আপাতত কোনো জবাব নেই, প্রশ্নের আকারেই তা ঝুলে থাকবে। বাংলাদেশের জন্য তা কতটা ভালো হলো বা কতটা খারাপ হলো, তা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ভূরাজনীতির দিকে নজর রাখতে হবে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক