যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ঝোঁক হলো অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী প্রবণতার মধ্যে দোলায়মান থাকা। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ছিলেন বাইরের দেশে হস্তক্ষেপবাদী। তাঁর উত্তরসূরি বারাক ওবামা ছিলেন কম। ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত হস্তক্ষেপবিরোধী। জো বাইডেনের কাছে আমরা কেমনটা আশা করতে পারি?
শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র সাতটি যুদ্ধ ও সামরিক হস্তক্ষেপে জড়িত হয়। কোনোটিই সরাসরি আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিযোগিতা ছিল না। জর্জ ডব্লিউ বুশের ২০০৬ সালের জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি বৈশ্বিক গণতন্ত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে স্বাধীনতার ধারণা ঘোষণা করেছিল।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের বাইরে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? ১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘের সনদ বৈধ বলপ্রয়োগের সুযোগ কেবল আত্মরক্ষা এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও আরও চারটি স্থায়ী সদস্যদেশের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে) অনুমোদিত পদক্ষেপের মধ্যে সীমিত করেছে।
বাস্তবে এ নীতিগুলো অসংগতভাবে এক হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং লিন্ডন বি জনসন দাবি করেছিলেন যে ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনী উত্তর ভিয়েতনামিদের আক্রমণ থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে রক্ষা করছে। কিন্তু ভিয়েতনামিরা নিজেদের এক জাতিই মনে করে, যাদের শীতল যুদ্ধের ক্ষমতার ভারসাম্যের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের সম্পর্ক ভালো।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়, প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ কুয়েত থেকে ইরাকি সেনা সরিয়ে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখতে বলপ্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করেছিলেন জাতিসংঘের সম্মিলিত নিরাপত্তা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। তিনি নিজেকে বাস্তববাদী মনে করতেন এবং সারায়েভোতে বোমাবর্ষণে বেসামরিক মানুষকে বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে মার্কিন টেলিভিশনে ক্ষুধার্ত সোমালিদের চাঞ্চল্যকর ছবি দেখে মোগাদিসুতে মানবিক হস্তক্ষেপের জন্য সেনা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কৌশলটি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। বুশের উত্তরসূরি বিল ক্লিনটনের সময়ে, ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে ১৮ জন মার্কিন সেনা সেখানে নিহত হন। এই অভিজ্ঞতার চাপেই ছয় মাস পর রুয়ান্ডার গণহত্যা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কিছু করায় বিরত থাকে।
বাস্তব দিক থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ এক ঝুঁকিপূর্ণ পন্থা। এর ব্যবহার দেখতে সরল হলেও আসলে তা নয়। ওবামা লিবিয়ায় হামলা করেছিলেন, কিন্তু সিরিয়ায় নয়। ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটন উভয়েই ২০১৬ সালে বলেছিলেন যে সিরিয়ায় গণমৃত্যু ঠেকানোয় যুক্তরাষ্ট্রের দায় রয়েছে।
যেমন দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আমেরিকান হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল মিশ্রিত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বিতর্ক করেন যে ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন বাস্তববাদী নাকি উদারতাবাদী ছিল? জর্জ বুশ প্রশাসনের কিছু কেন্দ্রীয় চরিত্র, যেমন রিচার্ড চেনি ও ডোনাল্ড রামসফেল্ড ছিলেন বাস্তববাদী। তাঁরা সাদ্দাম হোসেনের অধীনে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনে থাকা ‘নব্য-রক্ষণশীল’ (প্রায়ই যাঁরা হন সাবেক উদারতাবাদী) জোর দিয়েছিলেন গণতন্ত্র রপ্তানি এবং আমেরিকান দাপট বজায় রাখার ব্যাপারে।
মোটা দাগে বললে, হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব ফেলা হয়। এগুলো হতে পারে প্রচার, অর্থনৈতিক সাহায্য এবং বিরোধী দলকে অবরোধ চালাতে মদদ দেওয়া, সাইবার আক্রমণ, ড্রোন হামলা এবং সামরিক আগ্রাসন। নৈতিক দিক থেকে স্থানীয় স্বার্থ ও অধিকার দমন করায় বলপ্রয়োগের মাত্রাটি হিসাবে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
বাস্তব দিক থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ এক ঝুঁকিপূর্ণ পন্থা। এর ব্যবহার দেখতে সরল হলেও আসলে তা নয়। ওবামা লিবিয়ায় হামলা করেছিলেন, কিন্তু সিরিয়ায় নয়। ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটন উভয়েই ২০১৬ সালে বলেছিলেন যে সিরিয়ায় গণমৃত্যু ঠেকানোয় যুক্তরাষ্ট্রের দায় রয়েছে। কিন্তু কেউই তাঁরা সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে বলেননি। আর ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গই আসেনি।
একদল উদারবাদী বলে থাকেন, বিদেশে গণতন্ত্র স্থাপন করা আমেরিকার দায়িত্ব। কিন্তু বলপ্রয়োগ ও বিনা বলপ্রয়োগে গণতন্ত্র কায়েম করার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। উদ্দেশ্যের মতোই বাস্তবায়নের পন্থাও অনেক গুরুত্ববহ। নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে এগিয়ে নিতে বাইডেন কোথায় অবতরণ করবেন? তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও সুবিবেচনার ইতিহাস আমাদের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু কোনো কোনো সময় হঠাৎ ঘটনা ঘটে এবং ঘটনাবলি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ এস নাই: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের সাবেক ডিন