রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনায়াসে বলা যায় বাঙালিজীবনের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। শুধু বাঙালিজীবন নয়, বাংলার রূপবৈচিত্র্য, প্রকৃতি, সংস্কৃতি তাঁর মতো করে কে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। এটি বলা খুব বেশি অমূলক হবে না, বিশ্বের আনাচকানাচে কত লোকের এই বাংলার প্রেমে পড়ার শুরুই হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। তাঁর লেখনীর জাদুর টানে কত কত ভিনদেশি মানুষ এ বাংলার জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছে, প্রাণ জুড়িয়েছে ঋতু-রকমফেরের হাওয়ায়, বুকভরা বাতাস নিয়ে দৌড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠেছে, ‘স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।’
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল’-এর টানে এখন কোনো ভিনদেশি যদি পা রাখেন বাংলাদেশে, রবীন্দ্রনাথের প্রতি কী উষ্মাই না প্রকাশ করেন তিনি! ফাগুনে আমের বনে ঘ্রাণে পাগল হওয়ার বদলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে পড়ে কালো ধোঁয়া ও দূষিত বাতাসেই তিনি পাগল হয়ে যাবেন। তবে বিশ্বজুড়ে শিরোনাম হওয়া বাংলাদেশের বিষয়টি আগে থেকে নজরে এলে এখানে আসার ইচ্ছাটাই তাঁর মরে যাবে নির্ঘাত। যেহেতু বাংলাদেশ আবারও সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে নাম লিখে নিয়েছে। আর ঢাকা সবচেয়ে দূষিত বায়ুর রাজধানী হিসেবে গতবারের মতো এবারও দ্বিতীয়। যদিও দুর্মুখেরা বলতে চাইবেন, বিশ্বজুড়ে কোনো র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে চলে আসাটা তো গর্বেরই বিষয়! কিন্তু প্রবাস থেকে দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরতে ফিরতে কেউ যখন আবেগে গুন গুন করে ‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো’ গাইতে যাবেন, ঢাকার রাস্তায় নামতেই ‘ও বাবা গো’ বলে আঁতকে উঠতে হবে তাঁকে।
একসময় এ দেশে রোগীর আয়ু বাড়ানোর জন্য চিকিৎসকেরা হাওয়া বদল করতে পাঠাতেন। আর এখন সেই হাওয়াই বদলে গিয়ে আয়ু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের। করোনার কারণে কত মানুষ মারা গিয়েছে, সে সংখ্যা নিশ্চয়ই সবার জানা আছে। কিন্তু অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, এই ‘বুক-ভরা-মধু বঙ্গের’ দেড় লক্ষাধিক মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে শুধু দূষিত বায়ুর কারণেই।
বৈশ্বিক বায়ুমান নিয়ে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৯ সালে দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। সে বছরে অল্প বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ২০ শতাংশই ঘটেছে দূষিত বায়ুর কারণে। প্রতিটি শিশুর আয়ু ৩০ মাস করে কমে যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। প্রায় পৌনে এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ঘরের বাইরে বাতাসে ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম কণা পিএম-২.৫-এর কারণে। বাতাসে এ কণার উপস্থিতি হিসাব করেই সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার ২০২১ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ১ নম্বরে দেখা যায় বাংলাদেশকে।
আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। সেই সূত্রেই কয়েক দিন পরপর কোনো না কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা শুনি, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। এমন ‘মধুর বচনও’ শোনা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘গোপন রহস্য’ জানতে আগ্রহী বিশ্বের অন্যান্য দেশ। এখন সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়েই কি সেই ‘গোপন রহস্য’ জানান দিলাম আমরা!
মূলত আগের বছরের ‘সাফল্য’ আরও ‘একনিষ্ঠভাবেই’ অক্ষুণ্ন রেখেছি আমরা। কারণ, আগেরবার পিএম-১০ ও পিএম-৫ অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা আমলে নিয়ে বায়ুমান পর্যালোচনায় আমরা শীর্ষে ছিলাম। এবার তার চেয়ে আরও সূক্ষ্ম কণা হিসেবে করা হলেও আমাদের অবস্থানকে কেউ টলাতে পারেনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে কত বাহারি পরিসংখ্যান আমরা দেখলাম। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। সেই সূত্রেই কয়েক দিন পরপর কোনো না কোনো মন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা শুনি, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। এমন ‘মধুর বচনও’ শোনা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘গোপন রহস্য’ জানতে আগ্রহী বিশ্বের অন্যান্য দেশ। এখন সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়েই কি সেই ‘গোপন রহস্য’ জানান দিলাম আমরা!
আমাদের রাজনৈতিক রথী-মহারথীরা অমুক–তমুকের কারণে দেশের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হলো বলে প্রতিনিয়ত ‘মরি হায়, হায় রে’ করতে থাকেন। তবে বায়ুদূষণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুস সালাম বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় অন্য দেশের মানুষ আমাদের দেশে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। দেশে বিনিয়োগ কম হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই বায়ুদূষণ নিছক পরিবেশগত ইস্যু নয়, এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও সরাসরি জড়িত।
বায়ুদূষণ নিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে শব্দদূষণেও বিশ্বে শীর্ষ শহর হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেছে ঢাকা শহর। কী একটা অবস্থা! বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও শব্দদূষণবিষয়ক গবেষক এ বি এম বদরুজ্জামান বলছেন, ‘বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের সম্মিলিত নেতিবাচক প্রভাবে ঢাকা শহর অসুস্থ নগরে পরিণত হয়েছে।’
এদিকে ডায়রিয়া রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল (আইসিডিডিআরবি)। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে শামিয়ানা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। বছরের এ সময়ে গত ৬০ বছরের ইতিহাসে এমন ডায়রিয়া রোগী দেখেনি হাসপাতালটি। আচমকা কেন ডায়রিয়ার এমন ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটল, চিকিৎসকদের মতে তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, ঢাকার পানি ‘বিষাক্ত’ হয়ে গেছে। যদিও কয়েক বছর আগে ওয়াসার পানিকে ‘বিশুদ্ধ’, ‘শতভাগ সুপেয়’ ও ‘ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না’ বলে বিপাকে পড়ে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার তাকসিম এ খান। এক বেরসিক নাগরিক তাঁকে সেই নিরাপদ পানি নামের ‘শরবত’ খাওয়ানোর জন্য গিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সে কথা নিশ্চয়ই অনেকে ভোলেননি।
যা বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে কষ্ট বা যন্ত্রণাসহিষ্ণু দেশ হিসেবেও কোনো র্যাংকিংয়ে শীর্ষে চলে আসতে পারি আমরা। এখন এ পরিস্থিতি থেকে আদৌ কখনো উত্তরণ ঘটবে, সেটি কারও বলার সাধ্য নেই। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলার মাটি, জল, বায়ুর এমন হাল হবে, সেটিও কি বুঝে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? এর যে সহজে কোনো কূলকিনারা হবে না এবং ‘দুখের পরে পরম দুখ’ সইয়ে যেতে হবে আমাদের! এ জন্য হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের হয়েই অনুযোগ জানিয়ে গিয়েছেন এভাবে, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’
● রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক