বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা কতটুকু গণতান্ত্রিক

শুরুতে আসা যাক স্বৈরাচার প্রসঙ্গে। পল্লিবন্ধু এরশাদ দেশ পরিচালনা করেছিলেন রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থায়। নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল। একই সঙ্গে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিছুটা হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ ছিল। হয়তো তেমনভাবে সেটা কার্যকর ছিল না এটা ঠিক। তবে ১৯৯০ সালে তিনি পদত্যাগ করার পর থেকে বর্তমানে শাসনব্যবস্থা ও প্রধান নির্বাহীর অবস্থান কী, সেটা বিশ্লেষণ করছি।

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যেসব আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হবে বলে উল্লেখ আছে, তা নিম্নরূপ:

দ্বিতীয় প্যারা, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’

সেখানে চারটি মূলনীতির মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো ‘গণতন্ত্র’। আমাদের সংবিধানের বাকি অংশে বিভিন্নভাবে দেশের শাসনব্যবস্থার বিশদ তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয়, গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ বর্তমান সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়নি। বরং এক ব্যক্তির কাছে দেশের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, লক্ষ করা যায়।

এখানে আমি সংবিধানের ৫৫(২) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করছি, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’

একই সঙ্গে আমি সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করতে চাই, ‘যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।’

আমাদের দেশে সাধারণত যে দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, সে দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী সব নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হন।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি—

(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা

(খ) সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে। তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

৭০ অনুচ্ছেদের কারণে যেকোনো দলের কোনো সংসদ সদস্য তাঁর বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক বা তাঁর নির্বাচনী এলাকার জনগণের মতামতের প্রতিফলন স্বাধীনভাবে করতে পারবেন না। এ কারণে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা সরকারি দলের দলীয় প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সংসদে মতামত ও সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য থাকেন।

যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য গঠিত তিনটি স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা বা সংসদ এবং বিচার বিভাগ একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, তখন সে ব্যবস্থাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়। একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী শাসনব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একনায়কতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্রচর্চার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে সংবিধানের মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে একনায়কতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্রের চর্চার জন্য সংবিধানের এই বিষয়গুলোর সংশোধন প্রয়োজন।

সংসদের সিদ্ধান্তগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি: চতুর্থ ভাগ: বিল পাস হওয়া ইত্যাদি বিধি ৯৪) বা অল্প কিছু দ্বিতীয় তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে [সংবিধানের ১৪২(ক) (আ)] , যা আমাদের দেশের প্রায়ই সরকারি দলের থাকে। বর্তমান সরকারেরও আছে। ফলে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন লাভ করবে ও সংসদে তাই গ্রহণ করা হবে—এটাই অনিবার্য বাস্তবতা।

ফলে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাহী বিভাগের প্রধানের বা প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনো বিষয় সংসদে নিষ্পত্তির জন্য বা সংসদের হস্তক্ষেপের জন্য আনা হয়, তা বর্তমান বাস্তবতার আলোকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার সিদ্ধান্তের জন্য আনা হয়েছে বোঝায়। এখন আসা যাক নির্বাহী বিভাগ বা আইনসভার বাইরে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার আরেকটি স্তম্ভ বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন [আদালত ও ট্রাইব্যুনালের] উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকিবে।’ অর্থাৎ অধস্তন আদালত উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

আরও পড়ুন

আবার ১১৬-তে বলা আছে নিম্নরূপ, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ এখানে অধস্তন আদালতকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ১০৯ অনুচ্ছেদ ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’

অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া আর সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন বলে বাধ্যবাধকতা আছে। উক্ত বিষয় দুটি ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা অর্থ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে আনা। সে পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালত রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বের আওতাভুক্ত। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, ২২ অনুচ্ছেদ ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ স্পষ্টত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্যতম ২২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। একই সঙ্গে বলা যায়, ১০৯ অনুচ্ছেদ ২২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তথাপি আমরা বাস্তবে ১০৯-এর পরিবর্তে ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করছি।

এখন আসা যাক উচ্চ আদালতের বিষয়ে

‘৯৫(১) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দান করিবেন।’ এ বিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের সব বিচারক নিয়োগ রাষ্ট্রপতির হাতে। পরবর্তী ৯৫(২) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে, এবং (ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে; অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে; অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’

বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ৯৫(২) (ক) এবং (খ) অনুসারে যোগ্যতা বিবেচনা করে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ করছেন। এ বিষয়ে ৯৫(২) (গ) এ বর্ণিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা নির্ধারণের বিধান আছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের ভাবধারা মোতাবেক প্রধান বিচারপতি এবং সার্বিকভাবে বিচার বিভাগের, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে প্রাধান্য থাকা আবশ্যক। ৯৫(২)(গ)-এ বর্ণিত আইনটি সেভাবে প্রণয়ন করার কথা। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আইন করা হয়নি। এ অস্পষ্টতার কারণে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগটিও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে।

আরও পড়ুন

সংবিধান সংশোধন করে উচ্চ আদালতের বিচারপতির অপসারণ সংসদের মাধ্যমে করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে আসত। যেহেতু সেটি উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে, সে জন্য উচ্চ আদালতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে নেই। শুধু এইটুকু ছাড়া, বিচার বিভাগের নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বাকি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রীর আওতাধীন।

যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য গঠিত তিনটি স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা বা সংসদ এবং বিচার বিভাগ একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, তখন সে ব্যবস্থাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়। একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীতমুখী শাসনব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একনায়কতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্রচর্চার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে সংবিধানের মূলনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে একনায়কতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্রের চর্চার জন্য সংবিধানের এই বিষয়গুলোর সংশোধন প্রয়োজন।

  • গোলাম মোহাম্মদ কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা