বাংলাদেশের জন্য ভারতের রেডিও

.
.

এ রকম একটি মৈত্রী রেডিও স্টেশনের কথা আমরা চিন্তা করিনি। ভারত কেন প্রয়োজন মনে করেছে তার উত্তর ভারতীয় কর্তৃপক্ষই দিতে পারবে। জানা গেছে, এই রেডিও স্টেশনে ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের সংগীত পরিবেশিত হবে। ভারত-বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে নানা আলোচনা হবে। নিয়মিত খবর প্রচারিত হবে ইত্যাদি। এ ধরনের একটি রেডিও স্টেশনের কোনো চাহিদা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে বলেও শুনিনি। এই রেডিও থেকে প্রচারিত খবর, ফিচার, সংবাদ বিশ্লেষণ ইত্যাদি নিয়মিত শোনার আগে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। এই রেডিও চালু করার পেছনে ভারত সরকারের কী মনোভাব কাজ করেছে তা অনুষ্ঠান নিয়মিত শোনার পরই বোঝা যাবে। এক বা দুই মাস শুনেও তেমন কিছু বোঝা যাবে না।

বন্ধু দেশ ভারত যখন বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য একটি পৃথক রেডিও স্টেশন চালু করেছে, তখন এর পেছনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের শুভ চিন্তাই কাজ করেছে বলে মনে করতে হবে। বাংলাদেশে কারা এই রেডিও শুনবেন, কেন শুনবেন সেই প্রশ্নের উত্তরও নিশ্চয় কর্তৃপক্ষ আগাম সংগ্রহ করেছে। যেকোনো বড় কাজ করার আগে মার্কেট ফিজিবিলিটি স্টাডি করার একটা শর্ত থাকে। ভারত সরকার নিশ্চয় তা করেছে। তবে এই রেডিও স্টেশন ভারত সরকার পরিচালনা করবে বলে এর থেকে মুনাফা করার কোনো প্রশ্ন উঠছে না।

এই রেডিও স্টেশন উদ্বোধন করে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, আকাশবাণী মৈত্রীর সূচনার মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে। আমরাও এ ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করি এবং আমরা আশাবাদীও। তবে গণযোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় হতো বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো যদি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা যেত। বহু বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ এই দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ভারতের কেব্‌ল টিভি সংযোগ ব্যবসায়ীদের অন্যায্য দাবি ও নানা অসহযোগিতার ফলে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলই ভারতে প্রচারিত হয় না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে তথ্যমন্ত্রী ও কলকাতার উপহাইকমিশন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের কেব্‌ল ব্যবসায়ীরা এতই অনড়। শুনেছি, বাংলাদেশের টিভি সম্প্রচারের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা কোনো রাজ্য সরকারের নীতি বাধা নয়। বাধা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অন্যায্য শর্ত।

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করার জন্য অনেক কাজ করা যেতে পারে। অনেক কাজ হচ্ছেও। উভয় দেশে উভয় দেশের টিভি চ্যানেল দেখার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করা তেমন একটি কাজ। উভয় দেশের অন্তত ২৫টি টিভি চ্যানেলের দৈনিক ২৫ ভাগ অনুষ্ঠান থেকে দুই দেশের দর্শক-শ্রোতারা অনেক তথ্য, জ্ঞান ও বিনোদন পেতে পারেন, যা দুই দেশের জনগণের মনন সমৃদ্ধ করবে। দুই দেশের মানুষের ভুল ধারণার অবসান করবে। তাঁরা নতুন করে অনেক কিছু জানবেন ও বুঝবেন। অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হবেন, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব হতো না। টিভি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম। এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।

বন্ধুত্বের কারণেই বাংলাদেশে ভারতীয় শতাধিক টিভি চ্যানেল প্রচারিত হয়। যে ভাষা বাংলাদেশের অনেক দর্শক বুঝতে পারেন না, সেই ভাষার টিভি চ্যানেলও অবাধে প্রচারিত হচ্ছে। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সরকার, কেব্‌ল ব্যবসায়ী ও জনগণ এতই বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু এটা তো একতরফা। ভারত তার বিনিময়ে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে না। করার পথে যেসব বাধা তৈরি করা হয়েছে, সেই সব বাধা সরানোও হচ্ছে না। মূল কাজটি না করে ভারত সরকার ‘আকাশবাণী মৈত্রী’ নামের একটি পৃথক রেডিও স্টেশন বাংলাদেশের জন্য তৈরি করেছে!

আমরা আশা করব, ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, ভারতের ব্যবসায়ী ফোরাম, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ সবাই মিলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ভারতে (অন্তত বাংলাভাষী রাজ্যে) অবাধে প্রচারের ব্যবস্থা করার জন্য পদক্ষেপ নেবে। এ ব্যাপারে যেসব বাধা রয়েছে, আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা করবে।একই পণ্যের জন্য দুই দেশের দুই নীতি হতে পারে না। একই ইস্যুতে দুরকম নীতি বজায় রেখে দুই দেশের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করা কঠিন হবে।

চলচ্চিত্র আমদানি, রপ্তানি, যৌথ প্রযোজনা ইত্যাদি নিয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন করা এখনো সম্ভব হয়নি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো নীতিমালা তৈরি করার সময় দুই দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। ‘দুই দেশ’ বলা হলেও দুই দেশের বাস্তব পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে এক রকম নয়। আমেরিকা ও ভুটানের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে তাতে ‘দুই দেশ’ একই মানদণ্ডে বিবেচিত হয় কি? যদিও দুটিই স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রেও কোনো কোনো ইস্যুতে দুই দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় রাখতে হবে। নানা গোষ্ঠীর স্বার্থে আমরা চলচ্চিত্র আমদানি, রপ্তানি ও যৌথ প্রযোজনার ব্যাপারে কোনো বাস্তবসম্মত চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারিনি। এ জন্য চলচ্চিত্র জগতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের বড় ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যদি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত চুক্তি না হয়, তাহলে কোন সরকারের আমলে তা হবে? চলচ্চিত্র একটি বড় বিনোদন মাধ্যম।বাংলাদেশেও এখন বছরে দু–তিনটি ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে। তা আমরা ভারতের প্রেক্ষাগৃহে দেখাতে পারছি না। আমাদের ভালো সিনেমাগুলো ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্র উৎসব আলোকিত করছে। কিন্তু কলকাতা বা আগরতলায় সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।

এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের তরফে তেমন চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে হলে শুধু বক্তৃতা দিলে কাজ হবে না। কিছু বাস্তব কাজও করতে হবে। ভারত কিন্তু তাদের দেশের স্বার্থে খুব সক্রিয়। তাদের দেশের টিভি চ্যানেলকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের কেব্‌ল ব্যবসায়ীরা ভারত-অন্তঃপ্রাণ। তাঁরা এ ব্যাপারে শর্ত দেননি বা বাধাও সৃষ্টি করেননি। ভারতের সিনেমাও এখন ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশে মুক্তি লাভ করছে। টিভি চ্যানেলের বদৌলতে তাদের সিনেমা বহু আগেই বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টিভি চ্যানেলের সুবাদে হিন্দি ভাষাও আয়ত্ত করেছে বাংলাদেশের একশ্রেণির টিভি–দর্শক। আর অতি সম্প্রতি শুধু বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য ভারত একটি রেডিও স্টেশনও চালু করেছে। নিজের দেশের জন্য ভারতের এসব নীতি ও বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখেও বাংলাদেশ সরকারের বোধোদয় হচ্ছে না। বাংলাদেশের মন্ত্রী ও নেতারা দুই দেশের মৈত্রীর জন্য শুধু বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন। আর কাজ করে যাচ্ছে ভারত সরকার।

আমাদের বোধোদয় হবে কবে?

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া  উন্নয়নকর্মী