অতি সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি মামলার রায় বাংলায় লিখে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আশা করি, এই শুভ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। আমি অধীর আগ্রহী, একদিন আমাদের চিকিৎসাশিক্ষাও বাংলা ভাষায় হবে।
মনোচিকিৎসার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ নিয়ে দুবার থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের যাঁরা প্রশিক্ষণ দিতেন, তাঁদের অনেকেই ইংরেজি ভালো বলতে না পারার কারণে তাঁদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু ইংরেজি ভালো জানেন, তেমন একজনকে পাশে রাখতেন। দেশে ফেরার সময় তাঁদের দেওয়া সব বইগুলো ছিল তাঁদের ভাষায়, শুধু ছবিগুলো দেখার জন্য কষ্ট করে বিমানে সেগুলো বয়ে নিয়ে আসি। তাঁদের অভিমত, কয়েক যুগ আগে তাঁরাও ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁদের চিকিৎসাবিষয়ক বইগুলো পড়তে হয় তাঁদের ভাষায়। জাইকা ফেলোশিপ নিয়ে জাপানে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হলো। জাপানের একজন অধ্যাপক তাঁর লিখিত একটি সাইকিয়াট্রির বই বাংলাদেশে নিয়ে আসেন আমাদের জন্য, সেটিও জাপানি ভাষায় লেখা। চীনে গিয়ে তো আরও উদ্ভট অবস্থার মধ্যে পড়ি।
এককথায় পৃথিবীর উন্নত সব দেশে চিকিৎসাশিক্ষা দেওয়া হয় তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায়।এতে শিক্ষার গুণগত মান কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে পরিভাষা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোনো অজুহাতও দাঁড় করানো হয়নি।
বিদেশি ভাষায় বিদ্যার্জনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পঠিত বিষয়ের অর্থ, তাৎপর্য কেবল তখনই বোধগম্য হয়, যখন মস্তিষ্ক সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে নিজ ভাষার শব্দার্থে অনূদিত করে নিতে পারে। এ ধরনের শিক্ষাকে বলে সাবমার্শন বা নিমজ্জন/চুবানি/ডুবন পদ্ধতিতে শেখা। ভিন্ন ভাষার সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে বা সাঁতার কাটতে কাটতে জ্ঞান অর্জনের কষ্টকর প্রয়াস।এতে বোধবুদ্ধির গভীরতর স্তরের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
শব্দের অর্থ একটি গুপ্ত সংকেতে আবদ্ধ থাকে, যাকে আমরা বলি কোড। ভিন্ন ভাষার সেই কোডকে নিজ ভাষায় ডি-কোড করে তার অন্তর্নিহিত অর্থ, মর্ম রূপান্তর করে নিতে হয়। উভয় ভাষার ওপর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য না থাকলে এটি দুরূহ কাজ।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি স্বাদ পাওয়া যায় নিজ মায়ের রান্না করা খাবারে। তেমনি কেবল নিজ ভাষায় যে স্বাদ, তা অন্য কোনো ভাষায় পাওয়া অসম্ভব। আমরা যা খাই, সেগুলো হজমের জন্য রয়েছে আমাদের নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম। তেমনি আমাদের মন-মস্তিস্কে রয়েছে বিশেষ ধরনের বৌদ্ধিক কাঠামো, যার আলোকে আমরা সবকিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকি। প্রতিটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব সিমান্টিক বা ভাষার শব্দার্থগত দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য মাতৃভাষায় বিদ্যার্জন অত্যাবশকীয় শর্ত।
সভ্যতা বিকাশে ও আমরা দেখি এই ভাষার একক আধিপত্য। মানুষ অন্য প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়েছে ভাষার গুণে। পৃথিবীর প্রথম লিখিত ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় সুমেরীয় ও মিসরীয় ভাষায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে। চীনে পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। এই ভাষার কারণেই এই প্রাচীন সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল। অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম পণ্ডিতেরা গ্রিকদের মূল্যবান বইগুলো আরবিতে অনুবাদ করেছেন বলেই ওই সময়টি ছিল মুসলিমদের স্বর্ণযুগ, যখন ইউরোপ ছিল অন্ধকারে। আবার এরাই এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছে নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চার কারণে।
বিদেশি ভাষায় শিক্ষা মানে ‘যান্ত্রিক’ভাবে শেখা, যেখানে বিষয়বস্তুর গভীরতায় যাওয়া যায় না, বিষয়বস্তুর অর্থময়তার যে বিচিত্র ব্যঞ্জনা, তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনিগুলো সঠিকভাবে অনুরণিত হয় না।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশে যেখানে সর্বত্র শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় না, সেখানে চিকিৎসাশিক্ষার মতো টেকনিক্যাল ও জটিল বিষয় বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব কতটুকু বাস্তবসম্মত? যাঁরা ভাবছেন এটি অলীক চিন্তা, তাঁদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ইতিমধ্যেই আমাদের মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে লেকচার ক্লাসের অন্তত অর্ধেক বাংলায় করা হয়; ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নোত্তর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বেশির ভাগ বাংলাতেই হয়ে থাকে।
এ রকমটি অনিবার্য, কেননা বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে ও বুঝে নিতে মাতৃভাষায় আলাপচারিতা করতেই হয়। কোনো কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও এর বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে কথা বলতে গেলে মায়ের ভাষা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এসে যাবে। অন্তত হওয়া উচিত। আর প্র্যাকটিক্যাল বিষয়গুলো প্রায় পুরোটাই বাংলা ভাষায় করা হয়ে থাকে।
কিন্তু আমার প্রস্তাব, শুধু লেকচার ক্লাস বা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নয়, বাংলা ভাষায় লিখিত হবে মেডিকেলের পাঠ্যবই বা সহপাঠ্যবই। এটি যে রাতারাতি হয়ে যাবে তা নয়, তবে শুরুটা হতে হবে এখনই। প্রথমেই কোনো পাঠ্যবই নয়, এমনকি সহযোগী পাঠ্যবইও নয়। মেডিকেলের যেকোনো শাখার যেমন মেডিসিনের কোনো একটি বিশেষ রোগ—যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে কিছু মানসম্মত লেখা শুরু হলো। একই বিষয়ে বছরে শত না হলেও কয়েক ডজন ভালো লেখা বের হয়ে আসবে। এর মধ্যে হয়তো গুটিকয় উচ্চতর মানসম্পন্ন বলে সবার কাছে গৃহীত হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রোগগুলো নিয়েও লেখা হবে। ফলে একসময় সহপাঠ্যবই লেখাও শুরু হবে। যার সর্বশেষ পরিণতি হবে পূর্ণাঙ্গ টেক্সট বই লেখা।
এ রকমটি হতে হয়তো ৩০, ৪০ বা ৫০ বছরও লাগতে পারে। আমাদের উত্তরসূরিরা তখন মেডিকেলের টেক্সট বই বাংলায় পড়বে, পড়াবে ও নিজেরাও তেমন বই লিখবে—এ রকমটি আমার খুব বেশি চাওয়া হবে? সেই থাইল্যান্ডের কথাই বলছি, তারা তখন জানিয়েছিল, তাদের দেশে কাউকে অধ্যাপক হতে হলে নিজ ভাষায় মেডিকেলের টেক্সট বই লিখতে হয়। আমরা তো অনেকেই ‘এই সেই’ করে তথাকথিত গবেষণা প্রবন্ধ বের করে অধ্যাপক হই। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে কি অধ্যাপক হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে অন্তত অনুবাদকৃত পাঠ্যবই রচনার বাধ্যবাধকতা রাখতে পারি না? অনেক বই ঘেঁটে বই লিখতে হলে জ্ঞানের ভান্ডার যে প্রসারিত হবে, গভীরতর হবে, এটা নিশ্চিত।
আমি একজন অখ্যাত, নগণ্য সাইকিয়াট্রিস্ট হয়েও এ পর্যন্ত ১৯টি বই বাংলায় লিখেছি শুধু সাইকিয়াট্রি ও সাইকোলজির ওপর। প্রতিবছর বইমেলায় এক বা দুটি করে বই লিখি। এবারের বইমেলার জন্য ও ইতিমধ্যে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বই দুটোই একাডেমিক ঘরানার ও ক্লিনিক্যাল বই।
আমাদের দেশে প্রথিতযশা অনেক স্বনামধন্য চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তাঁরা যদি আরেকটু এগিয়ে এসে নিজ নিজ বিষয়ে ক্ষুদ্র আকারে হলেও একটি-দুটি বই লিখতে শুরু করেন, আমি বিশ্বাস করি, কয়েক বছরের মধ্যে একটি বিপ্লব ঘটে যাবে। এটি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, মানসম্মত হলে ওই সব বই সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা লুফে নেবেন। তাঁদের মূল টেক্সট বইয়ের পাশে সহপাঠ্য বই হিসেবে সেগুলো স্থান পাবে।
ডা. তাজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও মনোচিকিৎক
email-drtazul84gmail.com