২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাংলা ভাষার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার

‘পুরো একটি মাস বরাদ্দ তোমার জন্যে। ভাষার মাসে “সর্বস্তরে তুমি নেই” বলে কত কান্নাকাটি করি। তোমার কথা ভেবে ২১শে ফেব্রুয়ারি লক্ষ লোক শহীদ মিনারে যায়; লক্ষ গজ কালো কাপড়, গাদা গাদা গাঁদা ফুল, হাজার হাজার ব্যানার-ফেস্টুন...তবু মন ভরে না? বাংলা ভাষা, তোমার সমস্যা কী?’

‘তোমাদিগের স্তুতি আছে, প্রস্তুতি নাই! বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি জাতির শক্তি প্রদর্শনের জন্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের প্রয়োজন ছিল। ভাষা-দিবস সে প্রয়োজন মিটিয়েছে। বাছা! যে দিনটি আন্তর্জাতিক “মাতৃভাষা দিবস” হওয়াতে আহ্লাদে আটখানা হচ্ছ, সে দিনটি মূলত ছিল “রাষ্ট্রভাষা দিবস”, মনে পড়ে?’

“‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা” সংবিধানেই লেখা রয়েছে। ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন নামে একটি আইনও রয়েছে।’

‘কী আছে সেই আইনে?’
‘সরকারি, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নথি ও চিঠিপত্র, আদালতের সওয়াল-জবাব, রায় অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই আইন যিনি অমান্য করিবেন, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

‘আইনটা মানে কেউ? না মানার জন্যে শাস্তি হয়েছে কারও? শুধু শাসন ও বিচার বিভাগ এই আইনের আওতাভুক্ত। শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, ব্যবসায় ও মিডিয়াকে উপরোক্ত আইনের বাইরে রাখা হয়েছে কি ভুলবশত, নাকি ইচ্ছে করে? আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের বিচারক ও প্রশাসক। শিক্ষার মাধ্যম যদি বাংলা না হয়, তবে প্রশাসকেরা এবং বিচারকেরা বাংলা ভাষায় কাজ-কর্ম করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন না।’

‘প্রশাসনিক চিঠিপত্র এবং নথি বাংলাতেই লেখা হয়। আদালতেও বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া শুরু হয়েছে।’

‘ইংরেজিতে বিসিএস পরীক্ষাও শুরু হয়েছে। প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজিতেই পড়ানো চলছে। আগে (উচ্চ) মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন ছিল, সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও চালু হয়েছে।’
‘বাংলায় পরীক্ষা নেওয়া তো বন্ধ হচ্ছে না। বাংলা ভার্সনও বন্ধ হচ্ছে না!’

‘শিক্ষার দ্বৈত মাধ্যমের কারণে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি হবে। ইংরেজিতে যারা বিসিএস পাস করবে, ইংরেজি মাধ্যমে যারা ডিগ্রি পাবে, নিজেদের তারা এলিট ভাববে। বাংলায় পাস করা শিক্ষার্থীরা হয়ে যাবে ব্রাত্য, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, কর্মকর্তা। ক্ষমতার রাশ ইংরেজি মাধ্যমের লোকজনের হাতে থাকার কারণে চিঠি ও নথিপত্র অচিরেই পুনরায় ইংরেজিতে লেখা শুরু হতে পারে। তবে শ্রেণিদ্বন্দ্ব হবে মূলত অনুন্নয়নের ফলশ্রুতি। সর্বজনীন শিক্ষার অনুপস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সর্বজনীন শিক্ষাবিস্তারে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াবে ইংলিশ মিডিয়াম।’

‘কীভাবে?’

‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারে না, কারণ (চমস্কির মতে) প্রমিত বাংলার “ইনপুট” সে পায়নি, না বাড়িতে, না বিদ্যালয়ে। ইনপুটের অভাবে প্রমিত বাংলার মতো জাতীয় ভাষাই যদি শেখানো সম্ভব না হয়, তবে কোটি কোটি বঙ্গসন্তানকে ইংরেজির মতো বিজাতীয় ভাষায় দুরস্ত করা অসম্ভব। ইংরেজি ভাষা পড়ানোর উপযুক্ত লোকই যখন বাংলাদেশে নেই, অঙ্ক-সাহিত্য-বিজ্ঞান-ভূগোল-বাণিজ্য ইংরেজিতে পড়াবে কারা? ইংরেজি ভাষার ওপর দখলই যদি না থাকে, তবে অধীত বিষয় কীভাবে শিক্ষার্থীর দখলে আসবে? শিক্ষার্থীরা না শিখবে বাংলা, না শিখবে ইংরেজি, না শিখবে সাহিত্য বা বিজ্ঞানের মতো অপরিহার্য সব বিষয়। সুইডেনে কিছুদিন আগে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম সুইডিশ থেকে ইংরেজি করা হয়েছিল। দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা আর কোনো প্রশ্ন করছে না। প্রশ্নহীন জ্ঞান কি সম্ভব? বর্তমান শিক্ষানীতি বহাল থাকলে বাঙালি অচিরেই একটি অর্ধভাষী, অর্ধজ্ঞানী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।’

‘প্রমাণ?’

‘বাংলাদেশের করপোরেট সেক্টরের বড় সব পদে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়, কারণ ইংরেজি তারা ভালো জানে এবং নিজের কাজটাও ভালো বোঝে। ইংলিশ মিডিয়াম এবং ইংলিশ ভার্সন দেশের করপোরেট চাকরির বাজার ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ এই শিক্ষার্থীরা বাংলা আধা জানে, ইংরেজি সিকি জানে, কাজ জানে আরও কম। চীন স্বাধীন হওয়ারও বহু আগে থেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাচ্ছ তোমরা ঢাকায়, ইংরেজিতে পড়িয়ে। অথচ পদ্মা সেতু বানাচ্ছে চীনারা, চীনা ভাষায় পড়ে, পড়িয়ে। একদিকে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের কর্মক্ষম লোক বেকার থাকছে। এমন সৃষ্টিছাড়া, নিজের পায়ে কুড়াল মারা পরিস্থিতি ইংরেজ উপনিবেশ ছাড়া আর কোথাও কি আছে? ইংরেজ চলে গেলেও ইংরেজির ভূত তোমাদের মাথা থেকে যায়নি।’

‘বাঙালি একটি অভিবাসনপ্রবণ জাতি। কমলা হ্যারিসের মতো একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও হয়ে যেতে পারে আমাদের কেউ। ইংরেজি না জানলে কি চলবে?’
‘কোন বাঙালি-কন্যা কবে বিদেশে গিয়ে কমলা কিংবা গোলাপ ফোটাবে, তার জন্যে দেশের কলাবাগান, শাপলা চত্বর উজাড় করে দিতে হবে?’

‘বিদেশে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় টেক্সটবই নেই...।’

‘বিদেশ মানেই কি ইংল্যান্ড-আমেরিকা? চীন-জাপান-জার্মানি-ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি নয়। স্বল্পসংখ্যক বিদেশগামী উচ্চশিক্ষার্থীর জন্যে সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার মাধ্যম কেন ইংরেজি করতে হবে? ইংরেজি ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে, কিন্তু ইংরেজি ভাষা শেখা আর ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করা যে এক কথা নয়, এই সহজ সত্যটা তোমাদের মোটা মাথায় কবে ঢুকবে?

‘পাঠ্যবই অনুবাদের একটা প্রকল্প হাতে নিয়ে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্য শিক্ষককে নিজ নিজ বিষয়ের পাঠ্যবই অনুবাদের দায়িত্ব দাও। বছর পাঁচেকের মধ্যেই বেশির ভাগ পাঠ্যবই বোধগম্য বাংলায় অনুবাদ হয়ে যাবে। এক শ বছর ধরে চীন-জাপান এই কাজ করে আসছে। গৌরী সেন সরকার তো বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা করার জন্যে ৭০০ বিলিয়ন ডলার দিতেও অনিচ্ছুক নয়, জাপান কিংবা জার্মানি পর্যন্ত যেখানে সাহস করছে না।

‘সসম্মানে টিকে থাকার জন্যে সংরক্ষণ নয় বরং একটি ভাষার চার ধরনের প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক। ইংরেজির চারটি প্রতিষ্ঠাই রয়েছে, গারো কিংবা চট্টগ্রামির একটিও নেই। প্রমিত বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, বাংলা ভাষা আইনটিতে আরও কিছু ধারা যুক্ত করা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগের জন্যে একটি স্বাধীন ভাষা কমিশন স্থাপন করাও অপরিহার্য। ভাষা আইন যারা ভঙ্গ করবে, কমিশন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম পূর্বশর্ত। এটা কোনো আবেগ কিংবা হুজুগের বিষয় নয়।’
‘আর কিছু?’

‘“আমি কি ভুলিতে পারি!” বলে ফেব্রুয়ারির পরপরই ভুলে যাও! আমি আছি বলেই তুমি আছো! কথাটা মনে রেখো!’

শিশির ভট্টাচার্য্য ভাষাবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।