অনাদিকাল থেকে বাঁশের ব্যবহার বহুমাত্রিক। বাঁশবিহীন সমাজ পৃথিবীতে কখনো ছিল না, আজও নেই। মানুষের জীবনে বাঁশের প্রয়োজনীয়তা যে কতটা, তা লিখে তো নয়ই, বলেও শেষ করা যাবে না।
মানুষের প্রথম আত্মরক্ষার জন্যও আরণ্য জীবনে প্রয়োজন হয়েছে বাঁশের। বাঁশের লাঠির। ঘর বাঁধতে প্রয়োজন হয়েছে বাঁশের। ঘরের খুঁটি বাঁশের। বেড়ায় বাঁশ। চালের বাখারি বাঁশের, মাচা বাঁশের। এককালে মানুষ যাতায়াত করত গরুর গাড়ি ও নৌকায়। গরুর গাড়ির মাচা বাঁশের তৈরি। নৌকার ছই বাঁশের। লগি ছাড়া নৌকা চলে না। সেই লগিও বাঁশের। কাঠের তক্তার পাটাতন অনেক পরে, তার আগে বাঁশের ফালা দিয়েই পাটাতন বানানো হতো।
মানুষের জীবনে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশ। বিশেষ করে বাঙালির জীবনে বাঁশ জড়িয়ে আছে জীবনে ও মরণে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে নবজাতকের নাড়ি কাটা হতো এবং এখনো গ্রামে ধাইয়েরা কাটেন বাঁশের ছিলকা দিয়ে। খাতনা করতেও বাঁশের ব্যবহার। হাজামরা বাঁশের ছিলকা দিয়েই লিঙ্গের অনাবশ্যক ত্বক কর্তন করেন। দালান-কোঠা, যেখানেই মারা যান না কেন, শেষ আশ্রয় বাঁশের ঘরে। কবরে লাশ শুইয়ে মাটি চাপা দেওয়ার আগে বাঁশের টুকরা আড়াআড়ি করে দেওয়া হয়। তার ওপর বিছানো হয় চাটাই। সেটাও বাঁশের তৈরি। তারপর কোদাল দিয়ে ধুপধাপ করে ফেলা হয় মাটি। সেখানেই শেষ নয়। শিয়াল লাশ নিয়ে টানাটানি করতে পারে। সে জন্য প্রয়োজন হয় কবরে বেড়া দেওয়ার। সে বেড়াও বাঁশের।
এখন এলজিইডি রয়েছে। যেখানে–সেখানে ব্রিজ ও কালভার্ট। ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের পোয়াবারো। আমাদের শৈশবে তা ছিল না। ছোটবেলায় ইছামতী নদী পার হয়েছি বাঁশের সাঁকোতে। আর একটু বড় হয়ে সাইকেলটা কাঁধে নিয়ে বহু কষ্টে বাঁশের সাঁকো পার হতাম। এখনো গ্রামের বহু খালে বাঁশের পুল। সরকারি ভবন নির্মাণে কোথাও আজকাল লোহার রডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় বাঁশ।
জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বাঁশ। এককালে গ্রীষ্মকালে বাংলার আকাশে উড়ত ঘুড্ডি। সেই ঘুড্ডিও বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি।
এখন গ্রামের লোকেরাও ব্যাংকে টাকা রাখেন। সেখান থেকে পাঁচ হাজার কোটি উধাও হয়ে গেলেও মাননীয় মন্ত্রী বলেন, কুচ পরোয়া নেই, সামান্য টাকা। এককালে ৫০, ১০০ টাকাই ছিল অনেকের কাছে অনেক টাকা। গ্রামের মানুষ টাকাপয়সা সঞ্চয় করত ঘরের বাঁশের খুঁটি ছিদ্র করে। বাঙালির সেই বাঁশের ব্যাংকই ভালো ছিল। হল-মার্ক, ডেসটিনি, সোনালী হওয়ার সুযোগ ছিল না। সুতরাং আধুনিক ব্যাংকের চেয়ে বাঁশের ব্যাংক ভালো।
>গুপ্তহত্যা থামাতে সবচেয়ে আগে যা দরকার তা হলো রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি। আরও যা দরকার তা হলো সমাজে উঁচু নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা
বাঁশ নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। আমাদের বিদ্রোহী ও জাতীয় কবিরও বাঁশ বড়ই প্রিয়। তিনি বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর-হাতে রণ-তূর্য।’ রণক্ষেত্রেও বাঁশের লাঠির প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখন টার্গেট কিলারদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেই যুদ্ধে এক পক্ষের অস্ত্র চাপাতি হলেও জনগণকে এখন আত্মরক্ষার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বাঁশের লাঠি নিয়ে তৈরি থাকতে।
তবে পৃথিবীর সব দেশে বাঁশের বাস্তব ব্যবহার যতই হোক, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে বাঁশের রয়েছে বিমূর্ত ব্যবহার। আপনি কাউকে ঘায়েল করতে চান, তাকে বাঁশ দিন।
টার্গেট কিলিংসহ গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরায় বাঁশের লাঠি ও বাঁশি বিতরণ করা হয়েছে। [ছবি ও সংবাদ দেখুন প্রথম আলো, ১৫ জুন] বাঁশ ও বাঁশি বিতরণ অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সাহেব বলেছেন, এলাকায় টার্গেট কিলিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অনুষ্ঠানে অন্তত ৪০ জনের হাতে লাঠি ও বাঁশি তুলে দেওয়া হয়। একইভাবে মাগুরার চার উপজেলার সাতটি মন্দির এলাকায় সভা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি তুলে দেয় পুলিশ।
পুলিশের সদর দপ্তর থেকে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি বিতরণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে কি না, সে কথা প্রতিবেদনে নেই। ধারণা করি, তা হলে সব জেলাতেই একই সঙ্গে এই কর্মসূচি শুরু হতো এবং গ্রামবাংলার বাঁশঝাড়গুলো উজাড় হয়ে যেত।
সংখ্যালঘুরা বাঁশের ডালায় দেবতার ফুল নিয়ে মন্দিরে যাবেন, না হাতে বাঁশের লাঠি ও মুখে বাঁশি নিয়ে মন্দির ও নিজেদের পাহারা দেবেন, সে ব্যাপারে এসপি মহোদয় বিস্তারিত বলেননি।
পুলিশের এই লাঠি ও বাঁশি প্রকল্প খুবই সময়োপযোগী, তবে কিঞ্চিৎ বিলম্বিত। মাস দুই আগেই যদি পুলিশ এই লাঠি প্রকল্প গ্রহণ করত, তা হলে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে শ দেড়েক প্রাণ রক্ষা পেত। গ্রামে গ্রামে এখন কুলখানি আর চল্লিশা করতে হতো না। সংখ্যালঘুদের হাতে বাঁশি ও লাঠি না দিয়ে ভালো হতো লাখ খানেক লাঠি-বাঁশি নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিলে। যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখামাত্র নির্বাচন কর্মকর্তা বাঁশিতে জোরসে ফুঁ দিলে স্বেচ্ছাসেবকেরা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। কিছু প্রাণ তাতে রক্ষা পেত। ইউপি নির্বাচনের সময়ও পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেনি, জঙ্গি দমনের দায়িত্বও তারা তুলে দিল জনগণের হাতে।
টার্গেট কিলিং অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়েও প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তা যদি হতো তাহলে আমেরিকায় পক্ষকালের মধ্যে দুজন সংগীতশিল্পী ও ফ্লোরিডার রেস্তোরাঁয় ৪৯ জন নিহত হতেন না। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সদস্যও নিহত হতেন না। হাতে লাঠি ও মুখে বাঁশি নিয়ে সিঁধেল চোরের উপদ্রব থামানো যায়, পদ্মার চরে ধান কাটার সময় মারামারি করা যায়; গুপ্তহত্যা থামানো যায় না। গুপ্তহত্যা থামাতে সবচেয়ে আগে যা দরকার তা হলো রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি। আরও যা দরকার তা হলো সমাজে উঁচু নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা। যে সমাজে সত্য ও ন্যায়বিচার রয়েছে, সেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা হতে পারে না। বাঁশের লাঠির চেয়ে শুভবুদ্ধির শক্তি অনেক বেশি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।