ঘন ঘনই দেশ থেকে বেরিয়ে পড়া শ্রম অভিবাসনপ্রত্যাশীরা সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশের পথে ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশিরা উদ্ধার হয়েছেন একাধিকবার। বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছেন অনেকেই। এবার বসনিয়ার শহর ভেলিকা ক্লাদুসারের জঙ্গলে আটকে আছেন কয়েক শ বাংলাদেশি। ভয়ংকর, বিপৎসংকুল সব পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ কাজের সন্ধানে ছুটছেন। কোনো দেশের বাজারে শ্রমের উদ্বৃত্ত এবং মজুরি কম, অন্যদিকে কোনো কোনো দেশের বাজারে শ্রমের চাহিদা ও মজুরির উচ্চমূল্য পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এসব কারণেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শ্রম অভিবাসীরা উন্নত বিশ্বের শ্রমবাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। আমাদের শ্রমিকেরা এই পরিস্থিতির বাইরে নন। বিভিন্ন হিসাবমতে, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি; যদিও বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে এই সংখ্যা মাত্র ২৭ লাখ। এই কয়েক কোটি বেকারের মধ্যে অদক্ষ, গৃহিণী, গৃহস্থলীর কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের বিবেচনাও করা হয়েছে। আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৫০ লাখের কাছাকাছি হবে। এত বিশালসংখ্যক শ্রমিক কাজের সংস্থান করতে না পেরে জমিজিরাত বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি বসনিয়ার জঙ্গলে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা বৈশ্বিক শ্রমবাজারের ভারসাম্যহীনতা নতুন করে উন্মোচন করেছেন। ইউরোপীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে নানা পথ ও দেশ ঘুরে কয়েক শ বাংলাদেশি নাগরিক এখন বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলে অবস্থান করছেন। বসনিয়ার এই শহর ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বলকান দেশগুলো এখন মানব পাচারের নিরাপদ রুট। এই রুট ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় অভিবাসীপ্রত্যাশী শ্রমিকেরা প্রবেশ করছেন। তবে সবাই ইইউর দেশগুলোয় প্রবেশ করতে পারে না। নানাভাবে আটকে যান বা সীমান্তে ধরা পড়েন। আটকের পর নির্যাতনেরও শিকার হন।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তথ্যানুসারে, কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয় ইউরোপে পৌঁছাতে। ধারদেনা করে, জমি বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে অনেকেই এই অর্থ জোগাড় করে থাকেন। তাই ঘর থেকে বের হওয়ার পর তাঁদের আর ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। সবকিছু জেনেবুঝেই তাঁরা দেশ থেকে বেরিয়ে পড়েন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের আশায়। অনিশ্চয়তা হচ্ছে কীভাবে যাবেন, কোন দেশে যাবেন, আদৌ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিমানে এলেও এরপর শুরু হয় দুর্গম পথ পরিভ্রমণের ইতিহাস। হেঁটে বনজঙ্গল অতিক্রম করে, পাহাড় ডিঙিয়ে, সাগর পাড়ি দিয়েই তবে ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন অভিবাসনপ্রত্যাশী শ্রমিকেরা। আর কোনোভাবে যদি ইইউভুক্ত কোনো দেশে প্রবেশ ও স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়, তবে সচ্ছলতার নিশ্চয়তা এখানে আছে।
কিন্তু এই স্বপ্ন সহজেই ধরা দেয় না। ইইউভুক্ত কোনো একটি দেশে প্রবেশের পর শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করে, বিভিন্ন ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন সবাই। আবেদন করলে বাসস্থান ও ভাতা পাওয়া যায়। তবে সব দেশে সমান সুবিধা পাওয়া যায় না। সিরিয়া থেকে লাখ লাখ উদ্বাস্তু আসার পর পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বাস্তুদের সুযোগ-সুবিধা অনেক দেশেই হ্রাস পেয়েছে। কোনো কোনো দেশে কেবল মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। বাসস্থানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোথাও কোথাও আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বড় বড় হলরুমে শত শত অভিবাসীকে থাকতে দেওয়া হয়।
এসব আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির অভিবাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাত লেগেই থাকে। এর সঙ্গে মাদকও যুক্ত হয়। কখনো কখনো নারী অভিবাসীদের নিয়েও পুরুষ অভিবাসীদের মধ্যে বিবাদ–বিসংবাদ শুরু হয়ে যায়। এসব ঝুটঝামেলার সঙ্গে কাজ অনুসন্ধান ও দেশে অর্থ পাঠানোর চাপও যুক্ত হয় উদ্বাস্তুদের ঘাড়ে। কারণ, দেশে পড়ে আছে লাখ লাখ টাকার দেনা। মোদ্দাকথা, ওই সময় একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। নানা ধাপ ও জটিলতা পেরিয়েই অভিবাসীরা ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান।
একসময় ইউরোপের আসার সহজ পন্থা ছিল বিভিন্ন বাণিজ্যিক মেলা, সেমিনার বা সম্মেলনে যোগ দিতে এসে দেশে আর ফিরে না যাওয়া। এর পাশাপাশি রাশিয়া হয়ে বাল্টিক দেশগুলো দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন অভিবাসীরা। এরপর রাশিয়া হয়ে ইউক্রেন, স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইতালিতে ঢুকেছেন হাজার হাজার অভিবাসী। এত সংকট, শঙ্কা, অনিশ্চয়তা জেনেও মানুষ কেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশ ত্যাগ করে? এর মূল কারণ হচ্ছে উদ্বৃত্ত ও সস্তা শ্রমের অর্থনীতি। বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসনের ধারা বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। দেশ থেকে বিভিন্ন পথ দিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে হাজার হাজার বাংলাদেশি ইউরোপের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এটা সবাই জানে। বাংলাদেশ সরকার যেমন জানে; ইউরোপের সরকারগুলোও জানে। মাঝেমধ্যে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে। এ কারণেই বিভিন্ন জঙ্গলে আটকে পড়ার খবর আসে। তা না হলে সারা বছরই বিভিন্ন রুট ধরে মানব পাচার হতেই থাকে।
শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় তিনটি পক্ষ রয়েছে। শ্রমিক নিজেই একটি পক্ষ। এ ছাড়া শ্রমিক সরবরাহকারী ও গ্রহণকারী দেশ অপর দুই পক্ষ। শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রগুলো লাভবান হচ্ছে। বলা যায় রাষ্ট্রগুলো উইন-উইন অবস্থায় আছে। আর ঝুঁকিতে থাকেন শ্রমিকেরা। যে শ্রমিককে দেশে মাসিক ২০ হাজার টাকা আয় করতে গলদঘর্ম হতে হন, তিনি ইউরোপে মাসে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় করে দেশে পাঠান। তাই শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল ফুলেফেঁপে উঠছে।
আর ওদিকে ইউরোপে শ্রমিকের সংকট আছে। এরাও স্বল্প মূল্যে শ্রমিক পাচ্ছে। একজন অভিবাসী শ্রমিকের বেতন ইউরোপর দক্ষ শ্রমিকের থেকে অনেক কম। তাই তারা বিদেশি শ্রমিকদের ঢুকতে দিচ্ছে। তবে সরাসরি না। ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের চাহিদার জোগান দিচ্ছেন অবৈধ পথে আসা অভিবাসীরা।
এই রাষ্ট্রীয় উইন-উইন অবস্থায় ক্ষতির সম্মুখীন হন কারা? যাঁরা শেষ পর্যন্ত ইউরোপ এসে পৌঁছাতে পারেন না। নানাভাবে আটকে পড়ে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন বা ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের ঝাপটায় হারিয়ে যান। আমরা খবরে পড়ি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এতজন বাংলাদেশির সলিলসমাধি। অথবা অতসংখ্যক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক সমন্বিত শ্রম অভিবাসনব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর শ্রম অভিবাসন নীতি পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এখানে দায়িত্বটা উন্নত দেশগুলোরই বেশি। কোথাও শ্রমের চাহিদা থাকলে শ্রমিক সেদিকে ধাবিত হবেনই। এটা কোনোভাবেই আটকে রাখা যাবে না। এসব বিবেচনায় নিয়েই বৈশ্বিক শ্রম অভিবাসন নীতির পূর্ণ মূল্যায়ন করতে হবে। এতে সব পক্ষই জয়ী হবে। সাগরে হারিয়ে যাওয়ার বা বনজঙ্গলে আটকে পড়ার অবস্থা বারবার তৈরি হবে না।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক