বলিভিয়া: মোরালেস কি লিথিয়াম রাজনীতির প্রথম শহীদ?
ক্যুদেতা কীভাবে হয় কিংবা কীভাবে করতে হয়—এ নিয়ে ইতিমধ্যে জনপ্রিয় অনেক হ্যান্ডবুক আছে। তারপরও ১০ নভেম্বর থেকে বলিভিয়ায় যা ঘটছে সেটা কোন ‘ক্যুদেতা’ কি না, এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রচারমাধ্যমের কর্মীরা বিতর্কে আছেন। এই ক্যুদেতার পেছনে কারা আছে, সেটা নিয়েও বিতর্ক চলছে। ইভো মোরালেসের নির্বাচনী দুর্নীতি নিয়েও বিতর্ক আছে।
বিতর্ক ভালো। চলুক।
সেই গল্পে আপাতত অংশ নিতে চাইছি না। বরং সেই আলাপের ফুটনোট হিসেবে বলিভিয়ার লিথিয়ামের কাহিনি এখানে শেয়ার করা যেতে পারে। দুই-চার জনের কাছে হয়তো সেটা আগ্রহোদ্দীপকও হতে পারে।
তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের মতোই গত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে শুরু হওয়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবেও লিথিয়াম জরুরি। মোবাইল থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক কার—আজ ও আগামী দিনের প্রায় সব বৈদ্যুতিন যন্ত্রের প্রাণভোমরা যে ব্যাটারি, তার রসদ লিথিয়াম। স্মার্টফোন-বিপ্লব এগিয়ে নিতে এবং আসন্ন বৈদ্যুতিক গাড়ি-বিপ্লবের জন্য লিথিয়াম ব্যাটারি লাগছেই। যে কারণে একে ‘টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির গোল্ড’ও বলা হয়। সঙ্গে এ-ও বলা হয়, এ শতাব্দীতে বলিভিয়া হয়ে উঠতে পারে গত শতাব্দীর সৌদি আরবের মতো। কারণ পেট্রোলিয়ামের গুরুত্বের জায়গা নিতে চলেছে লিথিয়াম।
বলিভিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ হলো লিথিয়াম। আরও অনেক খনিজ আছে তাদের। বিশ্বের লিথিয়াম মজুতের প্রায় ৫০ ভাগ আছে বলিভিয়ায় দক্ষিণে আন্দিজ পর্বতমালার একেবারে ওপরের দিকে। পটোসি নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি কুইচুরা এবং আমারা আদিবাসীদের গরিব এলাকা।
বর্তমান দুনিয়ায় একটা গরিব দেশের হাতে লিথিয়ামের মতো একটা সম্পদ থাকা ঠিক মানায় না যেন! পুঁজি ও দক্ষতা বাড়ানো হয়নি বলে বলিভিয়া নিজ উদ্যোগে লিথিয়াম উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারেনি। দশকের পর দশক বহুজাতিক মাইনিং ফার্মগুলো এই সম্পদের সুবিধাভোগী। এর মাঝে ছিল ব্রিটিশ-সুইশ ‘গ্লেনকোর’, ভারতীয় ‘জিন্দাল স্টিল’, আর্জেন্টিনার ‘প্যান আমেরিকান এনার্জি’, কানাডার ‘ট্রাইমেটাল মাইনিং’ ইত্যাদি। এসব কোম্পানি বলিভিয়ার খনিজ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসমাজের ভালো-মন্দের তোয়াক্কা করেছে কমই। বিশ্ব বাণিজ্যে এটা অস্বাভাবিক নয়! এভাবেই আদিম সঞ্চয়ন অন্য ভাষায় বললে আদিম লুটপাট হয় এবং হবে। অনেকেরই বিশ্বাস হবে না, ১৯৯০ পর্যন্ত ‘লিথিয়াম করপোরেশন অব আমেরিকা’ এখানে এমন শর্তে লিথিয়ামের ব্যবসা করতে পারত যে, মুনাফার মাত্র ৮ ভাগ বলিভিয়াকে দিলেই হবে!
২০০৬ সালে প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে ইভো মোরালেস চাইছিলেন এই সম্পদে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বাড়াতে। তাঁর সরকারের একটা সিদ্ধান্ত ছিল এ রকম, খনিজ উত্তোলনের কাজটি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বলিভিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘কমিবল’ বা ‘ওয়াইএলবি’র সঙ্গে মিলে করতে হবে। মোরালেস সরকার লিথিয়াম উত্তোলন শেষে রপ্তানির আগে তাতে ‘মূল্য সংযোজন’ করতেও চাইছিল। এভাবে তারা বছরে প্রায় চার লাখ লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরির পরিকল্পনা করে। এ রকম ইচ্ছাটিই মৌচাকে ঢিল মারার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত।
২০১২ সালের আগস্টে ইভো মোরালেস সরকার ‘ট্রাইমেটাল মাইনিং’-এর সঙ্গে দেশটির পুরোনো চুক্তি বাতিল করে। বহু গড়িমসি এবং কানাডার সরকারকে দিয়ে ব্যাপক চাপ শেষে ২০১৯-এ মোরালেসের শর্তেই ‘ট্রাইমেটাল মাইনিং’ নতুন চুক্তি করে। বলা বাহুল্য, এতেও তারা অসুখী ছিল। (মূলত এ কারণেই কানাডা মোরালেসের নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের চেয়েও বেশি বলছিল ইদানীং!)।
২০০৭ সালে জিন্দালদের সঙ্গে পুরোনো চুক্তিও স্থগিত করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতে যায় জিন্দালরা। সেই মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত বলিভিয়ার বিপক্ষে রায় দেয়। প্রায় অনুরূপ কারণে ২০১৪ সালে প্যান আমেরিকান এনার্জিও আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয় বলিভিয়া সরকার বাড়তি রাজস্ব হিস্যা দাবি করায়। সেটা আপসে মীমাংসা করা হয়। মোরালেস সরকার ইতিমধ্যে গ্লেনকোর অনেক সুবিধাও কমিয়ে আনে।
এ সময়ই দৃশ্যপটে আসে চীনের ‘টিবিইএ’ গ্রুপ এবং ‘চায়না মেশিনারি’। মোরালাসের আমলে ২০১৮-এর মধ্যে চীন বলিভিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছিল। এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীন সেখানে লিথিয়াম খাতে ২.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করে বলিভিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ‘ওয়াইএলবি’র সঙ্গে যৌথভাবে।
গত জুলাই থেকে রাশিয়ার সঙ্গেও মোরালেস আলাপ শুরু করেছিলেন খনিজ খাতে বাড়তি বিনিয়োগের জন্য। এ সময় মোরালেস যুক্তরাষ্ট্রের টেসলা এবং কানাডার পিউর এনার্জি মিনারেলসের বিনিয়োগ প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। জনগণের বাধার কথা বলে জার্মানির এসিআই সিস্টেমস আলেমানিয়ার সঙ্গেও একটা চুক্তি বাতিল করা হয় কিছুদিন আগে। এভাবে মোরালেসের ‘অপরাধ’ প্রকৃতই আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল।
তবে এসিআইয়ের এক কর্মকর্তা ডয়েচ ভেলেকে চলতি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন, তাঁরা শেষ পর্যন্ত বলিভিয়ার লিথিয়াম পাবেন! এর এক সপ্তাহ পরই প্রেসিডেন্ট মোরালেসকে দেশ ছেড়ে মেক্সিকো চলে যেতে হয়েছে।
এদিকে মোরালেসের বিরুদ্ধে ‘আন্দোলন’ শুরু হওয়ার পরই আমেরিকায় বৈদ্যুতিক গাড়ির বড় ব্যবসায়ী টেসলার শেয়ারের দাম রকেটের বেগে বাড়তে থাকে। টেসলা জার্মানির এসিআই সিস্টেমস থেকেই ব্যাটারির সরবরাহ নেয়। কেন তার শেয়ারদর বাড়ছে, সেটা কেবল বাজার-বিশ্লেষকেরাই বলতে পারবেন! নিশ্চয়ই বিষয়টি অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়।
আন্তর্জাতিক মাইনিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মোরালেস সরকারের দ্বন্দ্ব-বিবাদের উল্লিখিত কাহিনি নিশ্চয়ই এত সংক্ষিপ্ত নয়, যত সংক্ষেপে সেটা বলা হলো। বিশেষ করে এর সঙ্গে বলা যেত মোরালেসের ‘গ্যাসযুদ্ধ’-এর গল্প। কিন্তু ২০১৯-এর ১০ নভেম্বর দ্রুতই এই গল্পের নতুন এক অধ্যায় দেখলাম আমরা।
বহুজাতিকদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে লিপ্ত হয়ে মোরালেস দেশটির অর্থনীতির আকার-আকৃতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, এটা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করে থাকেন। মোরালেস ক্ষমতায় আসার আগে বলিভিয়া হাইড্রোকার্বন খাত থেকে পেত বছরে ৭৩১ মিলিয়ন ডলার। মোরালেসের আমলে সর্বশেষ এটা দাঁড়িয়েছিল ৪.৯৫ বিলিয়ন ডলারে। কেবল এই ব্যবধানের কারণেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হলো, এমনটি বলা যাবে না।
নিশ্চয়ই ‘মূলধারা’র প্রচারমাধ্যমের এই ভাষ্যটিও ফেলনা নয়, মোরালেসের বিদায়ের পেছনে নির্বাচনী দুর্নীতির ‘অপরাধ’ও আছে। তবে এ তথ্যটিও বোধ হয় বিবেচনায় না রেখে উপায় নেই, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে লিথিয়ামের চাহিদা যে দ্বিগুণ হবে, তার একটা সস্তা উৎসও তো থাকা জরুরি ছিল! চীনের জন্যও বলিভিয়ার ঘটনাবলি এক বড় ধাক্কা। কারণ বিশ্ব ব্যাটারি বাজারের অন্তত ৬০ ভাগ তাদের দখলে ছিল এত দিন।
সারকথা, খনিজ হিসেবে লিথিয়াম যেভাবে অতি সক্রিয় ধাতু, আপাতত ভূরাজনীতিতেও তার তদ্রূপ সক্রিয়তা বিবেচনায় না নিয়ে চলছে না। বিশ্ব বহুকাল পেট্রোলিয়ামের রাজনীতি দেখেছে। যে আগুন নেভেনি এখনো। লিথিয়াম সেই আগুনের নতুন জ্বালানি হয়ে উঠল মাত্র। ইভো মোরালেস হয়তো সেই রাজনীতির প্রথম শহীদ মাত্র।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক