সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অক্ষয় কুমার অভিনীত সম্রাট পৃথ্বীরাজ সিনেমাটি বক্স অফিসে মোটেও ভালো করতে পারেনি। ছবিটি স্পষ্টতই ফ্লপ করেছে। অক্ষয় হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জনকারী অভিনেতাদের একজন। তিনি এমন একজন সফল তারকা, যিনি প্রধানতর হিন্দি ফিল্ম প্রোডাকশন হাউসের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজেকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই নায়ককে নিয়ে প্রচুর মিম এবং কৌতুক ভাসছে। অনেক মিম ও কৌতুকের মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছে, অক্ষয় কুমার বুঝি এরপর ‘ভারতীয় আলোকপ্রাপ্ত কুমার’ নাম দিয়ে নিজের বায়োপিক বানাবেন। এটা কি শুধুই অক্ষয়ের দেশভক্তির কারণে বলা হচ্ছে? উত্তরটা হয়তো সবারই জানা।
হিন্দি সিনেমার অন্য অনেকের মতো অক্ষয় কুমার ভারতের ইতিহাস কিংবা পৌরাণিক কাহিনির কোনো না কোনোভাবে সুপরিচিত, মাঝারিভাবে সুপরিচিত বা অপেক্ষাকৃত অপরিচিত ব্যক্তির জীবন বিশ্লেষণ করে বানানো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করে থাকেন। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নানা রকমের শৈল্পিক মসলা মিশিয়ে আকর্ষণীয় প্লটের সিনেমা বানানো হয়। এটি চলচ্চিত্রের পুরোনো একটি ধারা। এ ধরনের ছবি মানুষের মধ্যে জাতীয় গৌরব জাগিয়ে তোলে। মানুষকে জাতীয়তাবাদী করে তোলে। এই ধারার ছবিকে দর্শকদের হলে আনার একটি নিশ্চিত উপায় বলে মনে করা হয়।
বলিউডের এই পর্যায় আমাদের অক্ষয় কুমারের মতো একজন তারকার জীবন ও কাজ সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টিও দিয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাঁর ছবিগুলো ভারতের বিদ্যমান মূল ধারার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে তাল মিলিয়ে চলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর অভিনীত শেষ ছবি সম্রাট পৃথ্বীরাজ চরমভাবে মার খেয়েছে। তবে বক্স অফিসে সম্রাট পৃথ্বীরাজ-এর দুর্ভাগ্য প্রমাণ করে, ইতিহাসের ছদ্মাবরণে নির্মিত বায়োপিকগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ মরে যাচ্ছে—এখনই এমন উপসংহার টানা ঠিক হবে না।
এই জাতীয়তাবাদী ছবি ফ্লপ করার মানে এই নয় যে নিশ্চিতভাবে দর্শকেরা জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করছে। এমনও হতে পারে, ছবির ভাষ্য আগে থেকে দর্শকেরা অনুমান করতে পেরেছেন এবং সেই নির্দিষ্ট ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সিনেমাটি বানানো হয়েছে বলে তাঁরা আন্দাজ করেছেন। আর সে কারণেই হয়তো ছবিটি মার খেয়েছে।
এ ধরনের সিনেমার গল্প সাধারণত ভারতের অতীতের একজন নৃপতির জীবনকে ঘিরে বানানো হয়। তাতে সেই নৃপতির মহত্ত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা থাকে। সেসব চরিত্রের মহত্ত্বকে জনসাধারণের মাথায় বসিয়ে দিতে চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই ঐতিহাসিক বিবরণকে পাশ কাটিয়ে কল্পনার অতিরঞ্জনে তাঁদের চিত্রায়িত করা হয়। চিত্রায়িত সেই নতুন চরিত্রকে দর্শকের মনে বসানোর চেষ্টা করা হয়। ঐতিহ্যগত ইতিহাসের বাইরে যেসব অনুষঙ্গ জুড়ে দিয়ে সেটিকে সত্য বলে দাবি করা হয়, প্রায়ই সেগুলো মিথ্যা হয়।
সম্রাট পৃথ্বীরাজ-এর ব্যবসা করতে না পারার মূল কারণ যা-ই হোক, এ ঘটনা বলিউড এবং ভারতের রাজনীতিকদের মধ্যে পরিষ্কারভাবে একটি বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কোনো ছবি বানাতে হলে তা নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী ছবির পেছনে যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, তা সাধারণ দর্শক আগেভাগে টের পেয়ে যাচ্ছে। আর সেই উপলব্ধি তাদের এসব ছবি দেখার আগ্রহকে মেরে ফেলে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এসব ভাষ্যও চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখে থাকে। এগুলো জনসাধারণের আগ্রহ জাগানোর জন্য সুপরিকল্পিত প্রচারমূলক প্রচারণার অংশ। তবে বক্স অফিসে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ছবির মার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, এ ধরনের ছবি দেখতে দেখতে জনসাধারণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দর্শক হয়তো দূর অতীতের ধ্বংসাবশেষের দিকে না তাকিয়ে তাদের সমসাময়িক জীবনঘনিষ্ঠ গল্পচিত্র দেখতে চায়। আবার হয়তো একই তারকার ধারাবাহিকভাবে একই ধরনের ছবিতে অভিনয় করা নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশার অনুভূতিও থাকতে পারে।
এটা কি এই ধরনের সিনেমার প্রতি দর্শকের সাধারণ অনাগ্রহের বহিঃপ্রকাশ? নাকি অন্য তারকা থাকলে এই ফর্মুলা কাজ করত? নাকি দর্শকেরা একই ধরনের ছবিতে একই নায়ককে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। অন্যদিকে, কার্তিক আরিয়ানের ভুলভুলাইয়া টু ইতিমধ্যে বক্স অফিসে বড় ধরনের হিট করেছে। এই দুটি চলচ্চিত্রের গুণগত বিশ্লেষণ বা তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি এটিও বলছি না যে ভুলভুলাইয়া টু কোনো কারণে একটি উচ্চমানের সিনেমা। প্রকৃতপক্ষে, অনেক উপায়ে এই চলচ্চিত্রের সাফল্য এসেছে।
তবে সম্রাট পৃথ্বীরাজ-এর ব্যবসা করতে না পারার মূল কারণ যা-ই হোক, এ ঘটনা বলিউড এবং ভারতের রাজনীতিকদের মধ্যে পরিষ্কারভাবে একটি বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কোনো ছবি বানাতে হলে তা নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী ছবির পেছনে যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, তা সাধারণ দর্শক আগেভাগে টের পেয়ে যাচ্ছে। আর সেই উপলব্ধি তাদের এসব ছবি দেখার আগ্রহকে মেরে ফেলে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুনাল রায় পুনের ফ্লেম ইউনিভার্সিটির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষক