সরকারি কাজকর্মে বাধাদান একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। সরকারি কর্মকাণ্ড সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করেন মূলত সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী। তাই সে অর্থে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধাদানও একইভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য। তবে রাতের বেলা কোনো সরকারি কর্মকর্তার বাসভবনে সংঘবদ্ধভাবে চড়াও হওয়া, তা–ও আবার রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যানারে ; এটা কত বড় অসভ্য আচারণ, কতটা ফৌজদারি অপরাধ, এর সীমা নির্ণয় করা দুরূহ।
সরকারি অফিস ও কর্মকর্তার ওপর হামলার বা কাজে বাধাদানের বিচিত্র রকমের ইতিহাস এ দেশে আছে। হিংসাশ্রয়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এর অন্যতম। ‘সত্যাগ্রহ’ ধরনা, হরতাল, ধর্মঘট, বন্ধ্ ইত্যাদিও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার একটি ঐতিহ্য। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে জায়গাজমি, হাটবাজার, ব্যবসা, টেন্ডার ইত্যাদি দখল, অপদখল বা কোনো বেআইনি স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দেওয়ার সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা এ দেশে বিরল নয়। কখনো কখনো পুলিশের হেফাজত থেকে আসামি ছিনতাইও হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের ‘জনপ্রতিনিধি’র ইশারা-ইঙ্গিতে রাতের বেলা কোনো সরকারি কর্মকর্তার বাসভবন আক্রমণের নজির সম্ভবত এটিই প্রথম।
আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন ধরে প্রশাসনের অধিকর্তাদের শারীরিকভাবে নাজেহাল ও অপদস্থ করার ঘটনা বাড়ছে। দুর্বিনীত কোনো কর্মকর্তাকে নাজেহালের অংশ হিসেবে বদলি, কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন, গালাগাল ইত্যাদি তো আছেই। আজকাল সরাসরি জীবনের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ইতিমধ্যে সড়ক ও জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং এলজিইডির প্রকৌশলীদের নানাভাবে নাজেহালের অনেক ঘটনা দেখা গেছে। বেশ কিছুদিন ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) ওপর আক্রমণ, নানা রকম চাপ প্রয়োগ ও হয়রানির বিষয় জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এ প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা গেলেও প্রবণতাটা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।
১৮ আগস্ট বরিশাল সদরের ইউএনওর বাসভবনে রাতের বেলা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী, বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সংঘবদ্ধ হামলায় ইউএনও কর্তৃক দুটি মামলা করা এবং ২১ নেতা-কর্মী আটক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মামলায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ১৫ আগস্টের ‘জাতীয় শোক দিবস’-এর পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে এ ঘটনার সূত্রপাত বলে জানা গেছে।
বেশ কিছুদিন আগে বরগুনার কোনো এক উপজেলার ইউএনওকে নিয়ে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন এবং এ মামলাকে আমলে নিয়ে বরিশালের সিএমএম আদালত ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ইউএনও আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সাজু নামের ওই মামলাকারী দলীয় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইউএনওকে অযথা হয়রানির জন্য ছয় পুলিশ সদস্য প্রত্যাহৃত এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বরিশালের সিএমএম মো. আলী হোসেন অন্যত্র বদলি হন। মামলায় অভিযোগ ছিল, ইউএনওর ছাপানো দাওয়াতপত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি’ ব্যবহার করেছেন। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে বক্তব্য প্রদান করে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদে ‘আমলা’ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনামূলক ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে জননেতা তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন সমালোচনামুখর হন এবং ওই সময়ে ভোলার এক ইউএনওকে বদলির ব্যাপারে বিভাগীয় কমিশনার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তদবির শুরু হয় বলে পত্রপত্রিকায় খবর বের হয়। এক বছর আগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে রাতে সরকারি বাসভবনে মারাত্মকভাবে জখম করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে (সেপ্টেম্বর ২০২০)।
কয়েক বছর আগে (এপ্রিল ২০১৭) ভোলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফরিদুল আলম বোরহানউদ্দিন উপজেলার ভারপ্রাপ্ত ইউএনও এবং পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একজন রিলিফ চোরকে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগ এনে সুয়োমোটো মামলা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুজিব বর্ষের উপহারের ঘর নির্মাণের দুর্নীতির দায়ে প্রায় চার ইউএনও অভিযুক্ত হন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে গরিবের ঘরগুলো হস্তান্তরের আগে–পরে ভেঙে পড়া বা ফাটল ধরার ঘটনা দেশে উপজেলা প্রশাসনের বড় এটি কলঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনা ও রটনা দেশে মাঠ প্রশাসনের অস্থিরতার কিছু নমুনা।
বরিশালের সাম্প্রতিক ঘটনাটি এখন দেশের সর্বাধিক আলোচিত একটি বিষয়। শোনা যায়, পক্ষে-বিপক্ষে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এক পক্ষের (ইউএনও) মামলায় নামসহ ৪৪ জন ও নামহীনসহ সর্বমোট ৫০০ জন অভিযুক্ত এবং ২১ জন ইতিমধ্যে আটক হয়েছে। অপর পক্ষে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তার নালিশি মামলায় ইউএনও, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আনসার, পুলিশসহ প্রায় ৪০ জন আসামি। এ মামলা সিআইডি তদন্ত করছে। বিসিএস প্রশাসন অ্যাসোসিয়েশন এ নিয়ে কড়া বিবৃতি দিয়েছে। ২২ আগস্ট দুইজন মন্ত্রী (তাজুল ইসলাম ও হাছান মাহমুদ) গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। এর আগে আরেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। আর এই তিন মন্ত্রী ‘ভুল–বোঝাবুঝি’র ইঙ্গিত করলেন এবং শিগগিরই এর ‘নিরসন’ হবে বলেও আশা প্রকাশ করলেন।
দুই পক্ষে চারটি মামলা। বিচারাধীন বিষয়ে বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়। মামলাগুলো স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হবে বা চলবে, সেটি মনেপ্রাণে চাই। তবে ভরসা খুব একটা নেই। কারণ, বরিশালের এ ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। তা–ও আবার ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরের। শেষ পর্যন্ত যদি উভয় পক্ষের চারটি মামলাই প্রত্যাহৃত বা গতিহীন হয়ে যায়, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রশ্ন থেকে যাবে, এ সমাজ এ জনপদে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত ও অপরাধী চক্র দেশটাকে কোন খাদে নিক্ষেপ করছে!
সিটি করপোরেশন, এর মেয়র ও কাউন্সিলররা ‘জনপ্রতিনিধি’। তাঁদের কার্যক্ষেত্র সিটি করপোরেশন। করপোরেশন চৌহদ্দীর মধ্যে নাগরিকদের ‘মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস’ প্রদান তাঁদের মূল কাজ। জনপ্রতিনিধি হলেই ‘ধর্মের ষাঁড়’ হয়ে যেকোনো খেতে মুখ দেওয়া বা যেকোনো জায়গায় শিং চালানো যায় না। কোনো জনপ্রতিনিধিই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আর প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন না করাই শ্রেয়। দলীয় কর্মসূচির তো প্রশ্নই আসে না। বলবেন, জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড তথা জাতীয় শোক দিবস তো জাতীয় কর্মসূচি। এ কর্মসূচি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ জনগণ—সবাইকে নিয়ে তো পালন করা যায়। তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এ–জাতীয় কার্যক্রমেও যদি কোনো না কোনো স্থানীয় নেতা–নেত্রীর পেশি সঞ্চালনের অবকাশ সৃষ্টি হয়, সেখানে সতর্কতা আবশ্যক।
বরিশালে যে ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটানো হলো, এর মূলে হলো ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ, প্রাণ যাচ্ছে উলুখাগড়ার’। প্রশাসন এবং কিছু অতি উৎসাহী জনতা এর শিকার। বড় নেতারা তাঁদের নিজ নিজ অবস্থানে বহাল থাকবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নীতি ও নৈতিক শক্তি।
আইনের শাসন থাকলে যা হওয়া উচিত, তা হচ্ছে, হুকুমের আসামিসহ রাতে আক্রমণকারী সবার যথোপযুক্ত বিচার এবং শহরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ না করার জন্য করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়রসহ সব নির্বাহীর সাজা। অবশ্য বরিশালের নাগরিকদের পক্ষ থেকে করপোরেশনের সেবা বন্ধের বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি। নদী ও সড়কপথ বন্ধ করা হয়েছে, এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা। এ দেশে রাম-শ্যাম–যদু–মধুরা যখন-তখন কোনো সম্পাদক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলা করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যখন যাকে খুশি অবাঞ্ছিত ঘোষণা বা তালাবদ্ধ করছেন। কেউ আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে প্রতিপক্ষ শিকার করছেন। কেউ সরাসরি ফ্যাসিবাদী কায়দায় মানুষের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। এসবই গর্হিত কাজ। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিজের পেশাগত কারণে নিরপেক্ষ থাকার ও রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিমুক্ত থেকে নৈতিক মনোবল উঁচু থাকলে আখেরে দেশের লাভ।
তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ ও শাসন বিশেষজ্ঞ।
[email protected]