দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে ঘিরে দেশব্যাপী যে কাণ্ডকারখানা চলছে, তার প্রেক্ষাপটে আজকের এই লেখা। ইতিমধ্যে পাঠক ‘মাহ্ফুজ আনাম নাটকের’ সব ঘটনাই জেনেছেন। তার আর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
এ ঘটনার সূত্র ধরে আমরা বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চার একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এক–এগারোর সরকার পরিবর্তন কেন হয়েছিল, কারা এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী, কারা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিল, কারা এই পরিবর্তনকে ‘নিজেদের কৃতিত্ব’ বলে দাবি করেছিল, কারা কারা সেই সরকারকে সহযোগিতা করেছিল—সবই রাজনীতির বিষয়। আজকের লেখা রাজনীতি নিয়ে নয়, সাংবাদিকতা নিয়ে।
একটা বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে এক–এগারোর সরকার সেনা–সমর্থিত বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের একটি সিভিল মুখ থাকলেও তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছিল সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশে ও ইচ্ছায়। এ কারণে সেই সরকারকে ‘আধা সামরিক সরকার’ নামেও অভিহিত করা যায়। এক–এগারোর আধা সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (ডিজিএফআই) থেকে ওই সময় শেখ হাসিনার দুর্নীতি সম্পর্কে প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব দুর্নীতির তথ্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী সামরিক গোয়েন্দাদের জেরার মুখে তাদের কাছে ফাঁস করেছিলেন। এসব জবানবন্দির ভিডিও ফুটেজ ও অডিও টেপও তখন বাজারে বিলি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের (তাঁদের কেউ কেউ এখন মন্ত্রী ও এমপি) জবানবন্দির ভিডিও এখনো আগ্রহী দর্শকেরা ইউটিউবে দেখতে পাবেন।
সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ গণমাধ্যমকে কিছু তথ্য, প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা একটি প্রতিবেদন দিতেই পারে, এটা দোষের কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা বিভাগ গণমাধ্যমের একটা সোর্স হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন দিলেই কোনো সংবাদপত্র
বা টিভি তা প্রকাশ করে না। গণমাধ্যম সেই তথ্য নিজের সাংবাদিককে দিয়ে যাচাই–বাছাই করে। যাঁদের জবানিতে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করবে। প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত বা প্রাসঙ্গিক আরও কিছু ব্যক্তির মতামতও সংগ্রহ করে একটি সম্পূর্ণ প্রতিবেদন সংবাদপত্র বা টিভি প্রকাশ করে। এটাই সুষ্ঠু সাংবাদিকতা। একজন সম্পাদক বা বার্তা সম্পাদক এভাবেই সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
কিন্তু এক–এগারোর সরকারের সময় কোনো সংবাদপত্র ও টিভির পক্ষে এভাবে নিয়ম মেনে ডিজিএফআইয়ের পাঠানো সংবাদ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কারণ দেশে তখন ছিল জরুরি আইন ও আধা সামরিক শাসন। প্রচলিত আইন দিয়ে সরকার পরিচালিত হচ্ছিল না। ‘জরুরি অবস্থা’ বা ‘আধা সামরিক শাসন’ বললে এর আসল চরিত্র বোঝা যায় না। যেসব পাঠক জরুরি অবস্থা বা সামরিক শাসন দেখেননি, তাঁরা এর চেহারা কল্পনা করতে পারবেন না। এক–এগারোর সরকারের সময় অনেক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাকে সামরিক বাহিনীর লোকজন বাড়ি বা অফিস থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে গেছে, সেই খবরও অনেকে জানেননি। অনেক দিন পর জেনেছেন। অনেককে নিয়ে গিয়ে নির্দয়ভাবে মেরেছে। আরও নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করেছে। অনেক নির্যাতিত ব্যক্তি মুক্ত হয়ে বাইরে এসে এসব কথা বলেছেন। নির্যাতিত ব্যক্তি ও নির্যাতনকারী ছাড়া এসব ঘটনার কোনো সাক্ষী নেই। আওয়ামী লীগের নেতারা (সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, এমপি) এসব নির্যাতনের বর্ণনা এখনো দিতে পারবেন। বিএনপির নেতাদের মধ্যেও অনেকে এক–এগারোর সরকারের হাতে অমানবিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাঁরা এখনো সেই সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
এক–এগারোর সময় সংবাদপত্র ও টিভি কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান ও আরও অনেকের সম্পর্কে ডিজিএফআইয়ের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করতে বাধ্য ছিল। প্রতিবেদনগুলো ক্রস চেক করার কোনো সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি। সামরিক শাসনামলে অতীতেও কখনো ক্রস চেকের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটা নতুন কিছু নয়। তা ছাড়া ডিজিএফআই এগুলো প্রকাশ করার জন্য কোনো অনুরোধ করেনি, বরং আদেশ করেছিল। (আধা) সামরিক শাসনের কর্তাব্যক্তিদের আদেশ অমান্য করা সেদিন কোনো সম্পাদক, রাজনৈতিক নেতা বা ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জনাব মাহ্ফুজ আনাম টিভি টক শোতে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সম্পর্কিত ওই প্রতিবেদনগুলো সেদিন ডেইলি স্টার–এ প্রকাশ করে তিনি সম্পাদক হিসেবে ভুল করেছেন।’ আমি জনাব আনামের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এটা ভুল–শুদ্ধের বিষয় ছিল না। তিনি ডিজিএফআই বা সামরিক সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সাহস পাননি। ওই দিন সম্পাদক হিসেবে তিনি বা অন্য সম্পাদকের এটাই ব্যর্থতা; ভুল নয়। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর এবং ওই পত্রিকাটির মালিক। নিউ এজ–এর মালিক ও সম্পাদক খবরগুলো না ছাপানোর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তাঁদের অভিনন্দন।
জরুরি অবস্থা ও সামরিক শাসনের সময় কোনো সম্পাদক বা অন্য পেশার ব্যক্তি বন্দুকের নলের মুখে যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাকে ‘অন্যায়’ বলা উচিত নয়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা (এখন মন্ত্রী ও এমপি) সামরিক গোয়েন্দাদের চাপের মুখে তাঁদের নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ করেছিলেন। তা প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এক–এগারোর সরকার বিদায় নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ কি সেই নেতাদের বিচার করেছে? বহিষ্কার করেছে? শাস্তি দিয়েছে? আওয়ামী লীগ কিছুই করেনি। বরং সেই সব নেতাকে মন্ত্রী ও এমপি করেছে। তাহলে প্রায় একই ‘অপরাধে’ মাহ্ফুজ আনাম আজ ‘দেশদ্রোহী’ কেন? তাঁর বিচার চাওয়া হচ্ছে কেন? সত্যি সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ!
এগুলো রুগ্ণ রাজনীতির খেলা। সম্পাদকদের আসলে এখন চিন্তা–ভাবনা শুরু করা উচিত ভবিষ্যতে ডিজিএফআই বা এমন কোনো ক্ষমতাধর অফিস থেকে সংবাদপত্রে বা টিভিতে যদি ‘প্রতিবেদন’ পাঠানো হয়, তখন সম্পাদকেরা কী করবেন। এ ব্যাপারে মালিক ও সম্পাদকদের ফোরাম এখন থেকে আলোচনা শুরু করুক। না ছাপানোর পরিণাম কী হতে পারে, তা–ও আলোচনা করুক। সম্পাদকেরা কেউ বিপ্লবী বা জিহাদি নন। বুকে মাইন বেঁধে তাঁরা সংবাদপত্র পরিচালনা করতে আসেননি। সৎ সাংবাদিকতার জন্য ‘আত্মহত্যা’ বা ‘শহীদ’ হতে কজন সম্পাদক প্রস্তুত রয়েছেন, তা–ও আলোচনা করুন।
একটা ছোট সমাধান প্রস্তাব করতে পারি। সব পত্রিকা ও টিভি যদি এ ধরনের খবর প্রকাশ বা প্রচার না করার ব্যাপারে দৃঢ় থাকতে পারে, তাহলে কোনো সরকারই কোনো সম্পাদকের ÿক্ষতি করতে পারবে না। তবে বাংলাদেশের বর্তমান দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ রকম ঐক্য প্রায় অসম্ভব! দেশের পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, গণমাধ্যমের ঐক্যই গণমাধ্যমের শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ঐক্যবদ্ধ গণমাধ্যমকে কোনো অপশক্তিই পদানত করতে পারবে না। যত বড় বন্দুকের নলই হোক না কেন। সম্পাদক–মালিকেরা এই ঐক্যের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। যদিও জানি এটা কঠিন।
একটা টেস্ট হয়ে যাক। এখন তো দেশে একরকম গণতান্ত্রিক সরকার। দেশে বিরাজ করছে মোটামুটি মুক্ত সাংবাদিকতা। তবু প্রায়শ দেখা যায় সরকারের নানা গোয়েন্দা বা অন্য বাহিনীর অফিস থেকে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের রিমান্ডে দেওয়া জবানবন্দির বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া হয়, যা একতরফা। কোনো পত্রিকা বা টিভি কর্তৃপক্ষ এই বক্তব্যের ক্রস চেক করার সুযোগ পায় না। এখন সম্পাদকেরা একযোগে বলুন, ‘এ রকম একতরফা খবর আমরা আর প্রকাশ করব না। যার বক্তব্য আমাদের দেওয়া হয়েছে, আমরা তার সঙ্গেও কথা বলতে চাই। দুটি বক্তব্য আমরা পাশাপাশি প্রকাশ করব। শুধু সরকারি বক্তব্য আমরা প্রকাশ করব না। কারণ এটা সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুমোদন করে না।’
সম্পাদকেরা আরও একটা টেস্ট করতে পারেন। ক্রসফায়ারে মৃত্যুর খবরও সরকারি বক্তব্যের পাশাপাশি নিজেদের অনুসন্ধানসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায়। এখন পর্যন্ত পাঠকেরা ক্রসফায়ারে কারও মৃত্যু হলে শুধু সরকারি ভাষ্যই পড়তে পারেন। সেটা সৎ সাংবাদিকতা নয়।
বিদ্যমান গণতন্ত্রে এ দুটি টেস্ট করে দেখা যাক, আমরা কতটা সৎ সাংবাদিকতা করতে পারি।
১৯.২.২০১৬
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।