১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়, তার অশুভ চিহ্ন এখনো মিলায়নি। রাজনীতি এখনো তিক্ত মতাদর্শগত বিভক্তিতে আচ্ছন্ন। সুশাসন এখনো দূরায়ত। এ কথার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ আগের তুলনায় অগ্রসর হয়নি। ঠিক উল্টো, প্রবৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টির মাপকাঠিতে যদি উন্নয়নকে বিচার করি, তাহলে মানতে হবেই বাংলাদেশ জোর কদমে এগিয়েছে। এই বাংলাদেশ দেখে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত খুশিই হতেন।
তবে যে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কার্যত উপেক্ষিত রয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের গ্রাম। গ্রামই বাংলাদেশ, দেশের অধিকাংশ মানুষের বাস গ্রামেই, অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি। এমনকি যাঁরা শহরে বাস করেন, তাঁদের নাড়ির টান যে গ্রামেই, সে কথাও বেশ বোঝা যায় ঈদের আগে তাঁদের গ্রামমুখী হতে দেখে। এই গ্রামকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। এখনো পারে। কীভাবে, তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের গ্রাম (ইস্টার্ন একাডেমিক, ঢাকা ২০১৭) গ্রন্থে এ কথা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণে প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘গ্রামের প্রত্যেকটি কর্মঠ মানুষ এই বহুমুখী সমবায়ের সদস্য হবে। যার যার জমি সে-ই চাষ করবে, কিন্তু ফসল ভাগ হবে তিন ভাগে—কৃষক, সমবায় ও সরকার।’ এই গ্রামীণ সমবায়কে তিনি নতুন গ্রাম সরকার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের হাতেই উন্নয়ন বাজেটের অংশবিশেষ তুলে দেওয়া হবে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামও থাকবে তাঁদের হাতে। তিনি বলেছিলেন, ‘এরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে একসময় ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদের বিদায় দেওয়া হবে।’
বঙ্গবন্ধু যে সমবায়ের কথা বলছেন, তা চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের কলখোজ বা কালেকটিভ ফার্মিংয়ের থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও তা সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা দ্বারা অনুপ্রাণিত, তাতে ভুল নেই। নজরুল ইসলাম ধরিয়ে দিয়েছেন চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবের ফারাক কোথায়। তিনি কৃষকদের মালিকানাধীন জমি ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব করেছিলেন চাষ হবে যৌথভাবে, আর সে চাষের ফসল সবাই ভোগ করবে। নজরুল মনে করেন, বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাস থেকেই এই সমবায়–ব্যবস্থার প্রস্তাবনা। বস্তুত, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু নিজেই সমাজতন্ত্রে তাঁর আনুগত্যের কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না।’
সমবায় গ্রামের এই প্রস্তাব করার আগে বঙ্গবন্ধু ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে যে ভূমিস্বত্ব আদেশ তিনি জারি করেন, তাতে পরিবারপিছু সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং আরোপিত হয়। এর অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে সরকার অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু নিজ দলের ভেতরে প্রতিরোধের কারণে এই আদেশ কার্যকর হয়নি—যাঁরা দলের নেতা বা পার্লামেন্টের সদস্য, তাঁদের অধিকাংশই তো জোতদার। ফলে এই আইনের মাধ্যমে খুব সামান্য জমি উদ্ধার করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব হয়। নজরুল ইসলাম মনে করেন, ভূমি সংস্কারের বদলে সমবায়ভিত্তিক যৌথ চাষের যে প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু করেন, তা রাজনৈতিকভাবে আপসমূলক হলেও এটি ছিল অধিক বাস্তবসম্মত। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ এত কম যে বাধ্যতামূলক সিলিং আরোপ করে যে উদ্বৃত্ত জমি মিলবে, সব ভূমিহীনের মধ্যে তা বণ্টন অসম্ভব। তা ছাড়া বণ্টিত জমির আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ায় তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই জমির নতুন মালিক প্রতিবেশী জোতদারের কাছে তা বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। এই অবস্থায় একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে জমির যৌথভিত্তিক চাষাবাদ। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরাও যাঁর যাঁর মতো করে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু যে যৌথ চাষাবাদের প্রস্তাব রাখেন তা-ই নয়, তিনি পুরো গ্রামকে একটি সমবায়ী ব্যবস্থাপনার অধীনে আনার কথা ভেবেছিলেন। এ কথার অর্থ, গ্রামের যাবতীয় সম্পদ—তার জমি, ফসল ও পানি—এর ব্যবস্থাপনায় থাকবে গ্রামের মানুষের যৌথ ভূমিকা। এই সমবায়ী গ্রামের প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তৃতভাবে বলার সময়-সুযোগ তিনি পাননি, তবে তিনি কী চান, তার নানা ইঙ্গিত রেখে গেছেন। যেমন গ্রাম সমবায়ের মাধ্যমে যে বাড়তি আয় হবে, তার সুষম ব্যবহার ও বণ্টনের জন্য বঙ্গবন্ধু একটি ‘গ্রাম তহবিলের’ কথা ভেবেছিলেন। এই তহবিলের আয় আসবে উৎপাদিত ফসলের একাংশ থেকে, বাকিটা আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে।
বঙ্গবন্ধুর এই সমবায়ী গ্রামের প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখনো প্রাসঙ্গিক। নজরুল দীর্ঘদিন গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির সংস্কারে দেশি-বিদেশি নানা উদ্যোগের ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে। নজরুল ইসলাম মনে করেন, গ্রামের ক্ষমতায়নের একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে গ্রামকে একটি সমবায়ী ইউনিটে পরিবর্তিত করে তাকে গণপ্রশাসনের প্রথম স্তর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। তাঁর প্রস্তাব, এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘গ্রাম পরিষদ’। উদাহরণ হিসেবে নজরুল প্রতিবেশী ভারতের কথা বলেছেন। সেখানে পঞ্চায়েত–ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামের মানুষ নিজেরাই তাঁদের সব প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। চীনেও গ্রামীণ প্রশাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গ্রাম এখনো ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন। যাঁরা এই পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করেন, আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু নিজেই তাঁদের টাউট বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। চার দশক পরেও যে সে অবস্থা বদলেছে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন সমবায়ী গ্রাম নিজেই যদি একটি তুলনামূলকভাবে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ইউনিট হয়ে ওঠে, তাহলে সে টাউটদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। গ্রামেও যে টাউট নেই তা নয়, তবে ইউনিয়ন পর্যায়ের টাউটদের তুলনায় তাঁদের পেশির জোর কম, ফলে গ্রামের মানুষ এককাট্টা হলে তাদের ঠেকানো কঠিন নয়।
বঙ্গবন্ধুর ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নজরুল ইসলাম যে গ্রাম পরিষদের প্রস্তাব রেখেছেন, তা পরিচালিত হবে সমবায়ী গ্রামের সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ভোটে। এই পরিষদ একদিকে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা পালন করবে, অন্যদিকে স্বতন্ত্র ‘অর্থনৈতিক একক’ হিসেবে তা হবে সমবায়ী গ্রামের পরিচালনা পরিষদ।
এটা যে সম্ভব, নজরুল ভারতের মহারাষ্ট্রের গ্রামের উদাহরণে তার প্রমাণ দিয়েছেন। সেখানে আন্না হাজারে তাঁর নিজের গ্রাম রালেগান সিন্ধিতে শস্য ব্যাংক স্থাপন করেছেন, পানি সম্পদের সাশ্রয়ের মাধ্যমে পানিসংকট দূর করেছেন, গ্রামে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন, সেখানে অস্পৃশ্যতা দূর করেছেন। মহারাষ্ট্রের গ্রামে হলে এর সবই আমাদের গ্রামেও সম্ভব, কিন্তু সে জন্য চাই সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশাসন গ্রামের ক্ষমতায়নের কথা বলেছে, কিছু কিছু ‘অর্ধ-হৃদয়ী’ উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এরশাদ পল্লি পরিষদ আইন প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারও একাধিক আইন প্রণয়ন করেছিল বা আইনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেসবের অধিকাংশই ফাইলে বস্তাবন্দী হয়ে থেকেছে।
আমাদের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলই গ্রাম বাঁচানোর কথা বলে, গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে, এমন কথাও বলে। অথচ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে গ্রাম নেই। যেমন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে যে ২৬ দফা প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার ৮ নম্বরে রয়েছে কৃষি, খাদ্য, ভূমি ও পল্লি উন্নয়ন। মোট ১০৯ শব্দের সে কর্মসূচির বর্ণনায় কোথাও গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার কথা নেই, অথবা বঙ্গবন্ধু যে সমতাভিত্তিক গ্রামীণ সমবায়ের কথা বলেছিলেন, তারও উল্লেখ নেই।
১৯৭২ সালের জুন মাসে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেন্দ্রে তিনি দেখেছিলেন গ্রামকে। বাংলাদেশে এখন জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোল বেজে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই সময় জাতির পিতার এই স্বপ্নের কথা মনে রেখে গ্রামের প্রতি মনোযোগ দেয়, তাহলে একদিন সত্যি সত্যি সোনার বাংলা বাস্তবে পরিণত হবে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।