‘বাইরে গাছের নিচে বসলেই কাক মহারাজরা বদ কর্ম করে মাথা থেকে সমস্ত শরীর নষ্ট করে দেয়। জেলে কাকের উৎপাত একটু বেশি। কয়েক দিন পূর্বে একটা ধনুক বানাইয়াছি। ধনুকটাকে আমি “বন্দুক” বলে থাকি। ইটের গুঁড়া দিয়ে কাক বাহিনীদের আমি আক্রমণ করলেই ওরা পালাতে থাকে। আবার ফিরে আসে। কিছু সময় কাক মেরেও কাটাইয়া থাকি।’ [৩রা জুলাই ১৯৬৬। রবিবার, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৪৩]
প্রায় ৫০ বছর আগে প্রতিরক্ষা আইনে রাজবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে কাক দমনে ধনুক [‘বন্দুক’] বানাতে ও চালাতে হয়েছে। আজ তাঁর দল রাষ্ট্রক্ষমতায়, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের ভেতরে ‘কাউয়া’দের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে প্রকাশ্য সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি ধনুক বানাবেন কি না বা ধনুক বন্দুকের মতো ব্যবহৃত হবে কি না, সেই ঘোষণা পাওয়া যায়নি।
বিশেষ করে, এবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগে ‘হাইব্রিড’ শব্দটি ব্যাপকভাবে চালু হয়েছিল, ‘কাউয়া’ নবতর সংযোজন। যখনই কোনো অঙ্গসংগঠনের কোনো অপকর্মের কথা প্রকাশ পায়, তখনই বলা হয়: হাইব্রিডদের কারণেই এমনটি ঘটছে, অন্য দল থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা এমনটি ঘটিয়েছে। বিশ্বাস করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব মেলে না তা হলো, এই হাইব্রিড, যার কারণে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো, তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো? অথবা যার বা যাদের হাত ধরে এই হাইব্রিড প্রজাতি দলে আমদানি হলো, তার বা তাদের বিরুদ্ধেই বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
এই প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় একটি সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, দলে অস্বস্তি সৃষ্টি হলেও ওই হাইব্রিড বা কাউয়া দলের জন্য কোনো কারণে নিশ্চয়ই অপরিহার্য, কাজেই তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আর এই কাউয়াকে দলে এনেও নিশ্চয়ই কেউ অপরাধীও নন। তা–ই যদি হয়, তাহলে আর হাইব্রিড ও কাউয়া নিয়ে অহেতুক গলা ফাটিয়ে লাভ কী।
এই উপমহাদেশে মূলত সেনাশাসকদের প্রতিষ্ঠিত দলগুলোই কেবল হাইব্রিড আর কাউয়া আশ্রিত; কোনো আদর্শের ভিত্তিতে সেই দলগুলো গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার পালাবদলে সেনাশাসকেরা রাস্তা থেকে উচ্ছিষ্টভোগীদের যেমন দলে টেনেছেন, অন্যদিকে বিভিন্ন দলের ক্ষমতালোভী নেতারা বারবার রং বদলে সেনাশাসক বা উর্দি পাল্টে গড়ে তোলা নেতার দলে ভিড়েছেন। এ ছাড়া আদর্শবাহী দলগুলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় তাদের সংগঠন যেমন গড়ে তুলেছে, নতুন নতুন কর্মীও গড়ে উঠেছেন, তাঁরাই সংকটের নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দলের হাল ধরেছেন। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বা কেবল আদর্শিক ভুল শুধরে নেওয়ার জন্যও কেউ কেউ দল বদল করেছেন। নতুন দলে তাঁদের নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই নেতা-কর্মীদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে। কাজেই একটি দলে নতুন কেউ যোগ দিলেই তাকে হাইব্রিড বা কাউয়া বলা সরল সমীকরণ। বিবেচনাটি করতে হবে দলের প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততাকে মাপকাঠি ধরেই। দলের প্রতি অবিশ্বস্ত সবাইকেই চিহ্নিত করা প্রয়োজন; তা সে হাইব্রিড বা কাউয়া বা পুরোনো কর্মী, যে কেউ হোক না কেন। আমরা ভেবে দেখতে বলি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরে ধানমন্ডির সিঁড়িতে রেখে যাঁরা মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন, তাঁদের হাইব্রিড বা কাউয়া বলে বাতিল করা যাবে না। তাঁরা গৃহজাতই ছিলেন।
এ কথা ঠিক, দল ক্ষমতায় থাকলে নানা বলয় তৈরি হয়। এই বলয়ের মধ্যে নানাভাবে নানা জাতের খাদক ঢুকে যায়, এরাÿ ক্ষমতার সালাদ মাখিয়ে যা পায়, তা-ই খায়। তবে দল টিকে থাকে, কারণ সবাই খাদক হয় না, বিশ্বস্ততা দিয়ে প্রকৃত নেতা-কর্মীরাই দলকে রক্ষা করেন।
ফিরি বঙ্গবন্ধুর কাছে: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্জন সেলে নিজের একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বিশদ বলেছেন তিনি। ফুল, পাখি নিয়েও তাঁর ভাবনা হৃদয় স্পর্শ করে। তাঁর সেলের সামনে নিজ হাতেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি বাগান। নিজের বাগান সম্পর্কে লিখছেন, ‘চমৎকার লাগে। যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, ওগুলো না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ—যারা সত্যিকারের দেশ প্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়।’ [২৩শে জুন ১৯৬৬। বৃহস্পতিবার, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১১৭]
ভয়টি পরগাছা নিয়েই। যে পরগাছা দলকে ধ্বংস করতে চায়, সেটির উৎপাটন জরুরি—তা সে হাইব্রিড, কাউয়া বা দলের দীর্ঘদিনের নেতা, যা-ই হোক না কেন।
শেষ পর্যন্ত জেলের কাকদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বলছেন: ‘ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হই।...ওদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।’ [১১ই এপ্রিল ১৯৬৬, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২১৯-২২০]
বঙ্গবন্ধু ইতিবাচকভাবে কাকদের ধৈর্য ও অধ্যবসায়কে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যে কাউয়ার কথা বলছেন, তাদের তুলনা চলে সেই পরগাছাদের সঙ্গে, যাদের নিয়ে ভয়ের কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেও। ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক, নিশ্চয়ই তাঁর হাতে শক্তিশালী ধনুক আছে সেই কাউয়াদের পরাস্ত করার জন্য—সে হাইব্রিড বা গৃহজাত, যা-ই হোক না কেন।
মানবচরিত্র ব্যাখ্যা করে বলি: মানুষ তিন ধরনের; শত্রু, বন্ধু আর যার ওপর নির্ভর করা যায়। শত্রুকে বুঝতে পারি, তাকে পরাস্ত করার কৌশলও তৈরি করতে পারি। বন্ধুদের সঙ্গে পথ চলতে হয়, কিন্তু যে বন্ধুর ওপর নির্ভর করা যায় না, সে বন্ধু হচ্ছে ভয়ংকর বন্ধু। পথ চলতে চাই নির্ভর করা যায় এমন বন্ধু।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, কাজেই ঘরে-বাইরে তার শত্রুর অভাব নেই। ক্ষমতার মধুর রসের কারণে আওয়ামী লীগের বন্ধু এখন সর্বময়। এই বিশাল বন্ধুতালিকায় যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্ভর করা যায় এমন বন্ধু কারা, তা খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ, পথ চলতে হবে তাদের ওপর নির্ভর করেই।
উন্নয়নের বিশাল প্রমাণ আছে, বিশাল জনসমর্থনও আছে কিন্তু এই দুটিকে ভোটে রূপান্তরিত করতে পারাটা জরুরি। তা করা না গেলে তালিকা ও সংখ্যার হিসাব যা-ই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত অঙ্ক মিলবে না।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: প্রধান সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন।